• এপ্রিল ১৭, ২০২০
  • মতামত
  • 4996
ডাঃ মঈন উদ্দিনের জন্ম কর্ম স্মৃতি নিয়ে কিছু কথা

মতামতঃ প্রয়াত ডাক্তার মঈন উদ্দিনকে নিয়ে কিভাবে শুরু করবো আজকের লেখা, তাই ভাবছি। চিন্তার জগত আর স্মৃতিময় এ্যালবাম আজ লণ্ডভণ্ড, ডাক্তার মঈন উদ্দিনের মৃত্যুর পর করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুভয়ে কাঁপছে দেশের লক্ষ কোটি সাধারণ মানুষ। ডাক্তার মঈন উদ্দিনের মৃত্যুতে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা আজ হলো উন্মোচিত।

মঈন উদ্দিন কেমন মানুষ ছিলেন তা কি আর বলার অপেক্ষা রাখে। তার মৃত্যু দিনে অঝোরে কেঁদেছে লক্ষ কোটি মানুষ, সবই ছিল তার স্নেহ ভালোবাসা মানবিক দায়িত্ববোধের প্রতিদান।

ডাক্তার মঈন উদ্দিনের জন্ম ২ মে ১৯৭৩ ইং, পিতা মৌলভী মুন্সি ছিদ্দেক আলী, গ্রাম নাদামপুর, উপজেলা ছাতক, জেলা সুনামগঞ্জ।

তিন ভাই তিন বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন পঞ্চম। অল্প বয়সে পিতা মাতাকে হারান। পিতা ও মাতৃহীন মঈন উদ্দিন ছাত্র অবস্থায় ছিলেন অসাধারণ মেধাবী। নাদামপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণীতে টেলেন্টপুলে বৃত্তি পান, ১৯৮৮সালে এসএসসি পরীক্ষায় ৭২২ মার্ক পেয়ে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হলেন। হৈচৈ শুরু হলো পুরো উপজেলায়, তৎকালীন সময় কতটা মেধাবী হলে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হওয়া যায় তিনি ছিলেন উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

সিলেট এমসি কলেজ থেকে ১৯৯০সালে বিজ্ঞান বিভাগে ৭২৪ মার্ক পেয়ে এইচএসসি পাশ করলেন প্রথম বিভাগে। ভর্তি পরীক্ষায় হাজার হাজার প্রতিযোগীর মধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সুযোগ পেলেন মেধা তালিকায়। ছাত্র মঈন উদ্দিন ছিলেন মেধাবীদের মধ্যে এক উজ্জ্বল তারকা, মঈন উদ্দিনদের জন্যই মেধাবী শব্দটি সংযোজিত হয়েছে বাংলা অভিধানে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিবিএস, এফসিপিএস, এমডি ডিগ্রি অর্জন করলেন অসাধারণ কৃতিত্ব নিয়ে। তার কারণে সম্মানিত হয়েছে তার সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, তার কারণে সম্মানিত বোধ করেছেন তার অগণিত শিক্ষকরা। অল্প বয়সে হারিয়েছেন তার পিতা মাতাকে, কম বয়সে মারা গেছেন তার বড় দুই ভাই। এতো শোক কাটিয়েও তিনি ছিলেন কতো মেধাবী, তার বাকী তিন বোন ও উচ্চ শিক্ষিত সরকারী চাকুরীতে আছেন, ভাইরাও ছিলেন অনেক মেধাবী শিক্ষিত।

ডাক্তার মঈন উদ্দিন ছাতকের নূতন বাজার বহু মূখী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন ১৯৮৮ সালে, সে বছর ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে আমিও ভর্তি হই একই বিদ্যালয়ে।

তিনি আমার আত্মীয় এবং পাশের গ্রামের, তার পড়ালেখার প্রয়োজনে থেকেছেন সিলেটে পরবর্তীতে ঢাকায়, যে কারণে খুব বেশি দেখা সাক্ষাতের সুযোগ হয়নি। তিনি ছিলেন এলাকার ছাত্র এবং যুব সমাজের অহংকার আলোচনার কেন্দ্র বিন্দু, তাকে ঘিরে কতো স্বপ্ন ছিল এলাকার সর্বস্থরের মানুষের মনে। তিনি যখন বিভিন্ন উৎসব অনুষ্ঠান কিংবা ঈদে বাড়ি আসতেন অনুজদের নিয়ে আড্ডায় মেতে থাকতেন, প্রেরণা সঞ্চারিত হতো সবার মনে।

সামাজিক কর্মকাণ্ডে উদ্বুদ্ধ করতেন, পাড়া মহল্লায় গাছ লাগানোর তাগিদ দিতেন সবাইকে। তার উৎসাহে এলাকার ছাত্র শিক্ষিত যুব সমাজ একটি সামাজিক সংগঠন আমরা গড়ে তুলি নাম ছিল “আদর্শ পল্লী উন্নয়ন সমাজ কল্যাণ সংস্থা”। এক সময় আমি ছিলাম এই সংস্থার সাধারণ সম্পাদক তিনি ছিলেন সংস্থার উপদেষ্টা, তিনিকে সাথে নিয়ে আমরা প্রচুর গাছের চারা রূপণ করেছি।

২০০৪ সালে আমি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হলাম, তিনি খুবই খুশি হলেন শুভেচ্ছা জানালেন সাহস দিলেন। প্রায়ই বলতেন নিজেকে সৎ রাখতে হবে মানুষের জন্য ভালো কিছুর দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে।

আমার দীর্ঘ দিনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু সিলেট ল কলেজ ছাত্র সংসদের সাবেক এজিএস ফজরুল হক এনামের চাচাতো ভাই ডাক্তার মঈন উদ্দিন। এলাকার সামাজিক আঞ্চলিক বিভিন্ন প্রয়োজনে আমাদের দু’জনের প্রায়ই তার সাথে কথা হতো।

সত্যি আমি আজ বাকরুদ্ধ তিনি ছিলেন আমার প্রেরণার উৎস। তাকে ঘিরে কতো স্মৃতি, কতো কথা, কতো স্বপ্ন। বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় তার স্নেহের পরশ আর কোন দিন পাবো না।

এইতো মাস দুই এক আগে তার চেম্বারে গেলাম আমার নিজের শারীরিক কিছু সমস্যা দেখাবো, চরম ব্যস্ততার মাঝেও কতো কথা এক সময় বললেন নিজাম আমরা যারা নূতন বাজার বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে পড়ালেখা করেছি এখন সিলেটে বসবাস করছি তাদের সবাইকে নিয়ে সিলেটে একটা প্রোগ্রামের আয়োজন করো, আফজাল ভাইয়ের সাথে একটু কথা বলো, আমার সাথে কথা বলে সময় দিন ঠিক করে নিও। তার সে সামান্য চাওয়াটা পরিস্থিতির কারণে আর এগিয়ে নিতে পারিনি।
কতো দরদ ভালোবাসা মিশানো ছিল এলাকার প্রতিটি মানুষের প্রতি, শুধু কি এলাকার মানুষ ? তিনি বিনা ফি তে বিভিন্ন এলাকার দূর্গত অসহায় মানুষদের সেবা দিয়েছেন।

তিনি একজন হিসেবি মানুষ ছিলেন, হিসেবটা ছিল সময়কে নিয়ে। জীবনের প্রতিটি দিন প্রহর ব্যয় করেছেন মানুষের কল্যাণে,কাজে লাগিয়েছেন মিনিট সেকেন্ড প্রতিটি মূহুর্তকে।

তার কর্মস্থল ছিল সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ এবং হাসপাতাল, তিনি ছিলেন সেখানকার মেডিসিন এবং কার্ডিওলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। হাসপাতাল কলেজের তার দায়িত্ব পালন করে যেটুকুন সময় পেতেন, নগরীর ইবনে সিনা হাসপাতালে চেম্বারে বসে আর্তমনবতার সেবা দিতেন। বহু বছর থেকে প্রতি শুক্রবার তার গ্রামের বাড়িতে এলাকার মানুষদের বিনা ফি তে সেবা দিয়ে চলছিলেন, ধর্য্য বিনয়ী উদারতা মানব সেবার এক মূর্ত প্রতীক ছিলেন তিনি। ডাঃ মঈন উদ্দিনের স্ত্রী ডাক্তার রিফাত জাহান, সিলেটের খ্যাতিমান একজন ডাক্তার নূর আহমদ তার শশুড়, তার শাশুড়িও একজন ডাক্তার।

দেশ এলাকাকে নিয়ে হয়তো ডাঃ মঈনের অনেক স্বপ্ন ছিল। বেঁচে থাকলে তিনি হতেন রাষ্ট্রের জন্য সম্পদ, আত্মীয় প্রিয়জনের জন্য হতো কতো সম্মান। তিনি লক্ষ লক্ষ মানুষকে সেবা দিলেও এই রাষ্ট্র ব্যর্থ হলো মাত্র একজন ডাক্তার মঈন উদ্দিনকে সেবা দিতে ?

গত বুধবার ভোর ৬.৪৫ মিনিটে তিনি মৃত্যু বরণ করলেন, বিকাল ৩ টার পর সিলেট অঞ্চলে হঠাৎ হলে গেল ঘূর্ণিঝড়। আমার কাছে তখন কেন যেন মনে হলো ডাঃ মঈন উদ্দিনের অভিশাপের ঝড় বয়ে গেল সিলেট সহ বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। জানিনা এই ঝড়ের হাওয়া রাষ্ট্র ক্ষমতায় যারা আছেন তাদের গায়ে লেগেছে কি না।

কীর্তিমানের মৃত্যু নেই প্রবাদটি সত্য হলেও, কেমন করে মেনে নেই ডাক্তার মঈন উদ্দিন আমাদের মাঝে আর ফিরবেন না। ডাক্তার মঈন উদ্দিনের মৃত্যুশোকে এলাকায় হয়েছে আজ অশ্রুবন্যা, এলাকাবাসীর হাজারো স্বপ্নকে করেছে বিপর্যস্ত। তার শোকে ব্যথিত হয়েছে চেনা অচেনা দেশ প্রবাসে কোটি কোটি মানুষ, কেঁদেছে আজ বিশ্ব মানবতা। তার অকাল মৃত্যু মেনে নিতে পারেনি দেশের মাটি এবং মানুষ, ১৫ এপ্রিল সকালে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে তার মৃত্যু সংবাদ প্রকাশের পর শোকে স্তব্ধ হয়ে গেল পুরো দেশ কেঁপে ওঠলো ভূ মন্ডল। তার মৃত্যু সংবাদ কারও বিশ্বাস হচ্ছিল না মেনে নিতে পারছিল না কেউ, যখন বিশ্বাস হলো সত্যি তিনি চলে গেছেন এ পৃথিবীর মায়র বাঁধন ছিন্ন করে। মহুর্তেই শুরু হলো আত্মীয় প্রিয়জন দেশবাসীর ক্রন্দন, শোকের ঝড় বইলো ফেইসবুক অন্যান্য মিডিয়ায়। কেউ স্বাভাবিক হলো নিয়তির বিধান মেনে, কেউ বা রাগে ক্ষোভে বলতে শুরু করেছে তার প্রতি রাষ্ট্রের ছিল চরম অবহেলা অবিচার।

জীবনে কতো নিকটজনের মৃত্যু দেখেছি, দেখেছি কত বড় বড় ট্রাজেডিতে শত সহস্র মানুষের প্রাণহীন দেহ। কিন্তু বিশ্বাস করুন, বিশ্বাস করুন একজন ডাক্তার মঈন উদ্দিনের মৃত্যুর মতো নিজেকে এতোটা ক্ষতবিক্ষত বিপর্যস্ত বিমুঢ় হইনি কখনও। ডাক্তার মঈন উদ্দিনের মৃত্যু সংবাদের মূহুর্তে হৃদয় মুষড়ে ওঠে, মনে হয়েছে একটি অঞ্চলের বা রাষ্ট্রের জন্য হঠাৎ ঘোষণা ছাড়া বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া যা যুগের পর যুগ অন্ধকারে রাখবে জাতি অঞ্চলকে।

ডাক্তার মঈন উদ্দিনরা মৃত্যু দিন পর্যন্ত নিজেকে উজাড় করে রাষ্ট্রের তরে বিলিয়ে গেল, বিনিময়ে রাষ্ট্রযন্ত্র তাকে নিয়ে করলো কতো উপহাস অবহেলা। মৃত্যুর আগে বেঁচে থাকার জন্য কতো করুণ নিবেদন করেছিলেন, তার প্রিয় কর্মস্থল সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আইসিইউতে তাকে যেন নেওয়া হয়, নয়তো যত দ্রুত এয়ার এম্বুলেন্সের মাধ্যমে ঢাকার উন্নত হাসপাতালে। আজ প্রশ্ন জাগে লক্ষ কোটি মানুষের মনে, এই অধিকারটুকু থেকে কেন তাকে বঞ্চিত করা হলো ? তার মৃত্যুর আগে রাষ্ট্র চোখ বন্ধ করে থাকলো কেন, তার মৃত্যুর পর পরিবারের সমস্ত দায়িত্ব আপনি নিয়ে নিবেন ? তার প্রিয়জন অঞ্চলের ক্ষতি কি এভাবে পুষবে ! নিশ্চয়ই না ?
কষ্টের পাথরে চাঁপা পড়েছে কতো স্বপ্ন অনুভূতি, নিস্তেজ বাকরুদ্ধ আজ এলাকা, নীরব আর্তনাদ আর বুকফাটা কান্না।

করোনার ঝড় একদিন থেমে যাবে কল কারখানা যান্ত্রিক জীবন শুরু হবে। একজন ডাঃ মঈন উদ্দিনের শূন্যস্থান আমাদের জন্য শত বছরেও হয়তো পূরণ হবে না।

আমাদের ক্ষমা করো হে কর্মবীর শহীদ ডাক্তার মঈন উদ্দিন, তোমার জানাজা দাফনে যেতে পারিনি যতটা ভয় করোনাভাইরাস নিয়ে, তার চাইতে কম ছিল না তোমার জানাজা দাফনে রাষ্ট্রের ব্যবস্থাপনা নিয়ে।

এই রাষ্ট্রের কাছে তোমার জন্য আমাদের আর কোন চাওয়া নেই, নেই কোন অভিযোগ। তোমার কিছু চাওয়া, রেখে যাওয়া কিছু প্রশ্ন কষ্ট দিবে শুধু প্রিয়জনকে।
শুধু দোয়া করি তোমার দুই সন্তান যেন তোমার স্বপ্নের চাইতেও অনেক অনেক বড় হয়।

তোমার জন্য মানুষের বুকফাটা কান্না আজ আকাশে বাতাসে দেশের সীমানা পেরিয়েছে, যা তুমি দেখবে না? অগণিত মানুষের দোয়া নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাকে জান্নাতবাসী করে নিবেন।

তোমার কাছে হেরেছে রাষ্ট্র, জয় হয়েছে তোমার মানবিক দায়িত্ববোধের দরদী মানব সেবার,জয় হয়েছে তোমার মহৎ প্রাণের। হে কর্মবীর, তোমার জন্য যুগের পর যুগ থাকবে হৃদয়ের অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ভালোবাসা, নিশ্চয়ই তোমার কবরে ঝরবে অগণিত মানুষের অশ্রুজল।

লেখক মোঃ নিজাম উদ্দিন,
সাবেক চেয়ারম্যান খুরমা (উত্তর) ইউনিয়ন পরিষদ, ছাতক।
যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সুনামগঞ্জ জেলা বিএনপি।