• এপ্রিল ২৮, ২০২০
  • মতামত
  • 4404
ডাক্তার মঈন উদ্দিন কেমন মানুষ ছিলেন? তাঁহার মৃত্যুর পর কেমন ছিল মানুষের অনুভূতি?

মতামতঃ স্বাস্থ্য বিভাগ হয়তো গোপন রাখতে চেয়েছিলেন তাদের প্রাইভেসীর প্রয়োজনে। গোপন কি রাখতে পেরেছিলেন? ৫ই এপ্রিল রাত ৮ টার পর এক কান দুই কান হয়ে একটি সংবাদে কেঁপে ওঠলো পুরো সিলেট বিভাগ। সিলেটে প্রথম করোনা আক্রান্ত সনাক্ত ব্যক্তি স্বনামধন্য চিকিৎসক সকলের প্রিয় ডাক্তার মঈন উদ্দিন। মূহুর্তে ফেইসবুকে ঝড় ওঠলো, কেউ ভয়ে কাঁপলো কেউ তিনির জন্য নামাজ পড়ে দোয়া করলো।

ডাঃ মঈন মামার আক্রান্তের সংবাদে অজানা এক আতঙ্কে আমার দেহ মন কেঁপে ওঠলো। ৫ ই এপ্রিল রাত ১টা ১২ মিনিটে ফেইসবুকে খুব ছোট্ট করে লিখেছিলাম “সিলেটে প্রথম করোনা শনাক্ত প্রথম ধাক্কাটা আমার কলিজায়, তিনি আমার আত্মীয় এবং নিজের চিকিৎসক। আল্লাহ তোমার খাস রহমত দিয়ে তিনিকে হেফাজত করো।

ঘুম থেকে ওঠে ফেইসবুক ম্যাসেজ চেক করলাম প্রায় পাঁচ শতাধিক কমেন্টস, সবাই তাদের প্রিয় শ্রদ্ধেয় মানুষটির জন্য যে যেভাবে পেরেছেন দোয়া করেছেন। তখনই অনুভব হল তিনির প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা ভালোবাসা, মনে হল মানুষের প্রয়োজনবোধ।

একদিন দুইদিন পর চেনা জানা আত্মীয় স্বজন এলাকাবাসীর শঙ্কা প্রকট হতে লাগলো। গ্রাম এলাকা ছাতক উপজেলাসহ দেশ প্রবাসের অনেক যায়গায়, তার জন্য ঘরে বাইরে মসজিদে মসজিদে লক্ষ লক্ষ মানুষ দোয়া চাইলেন আল্লাহর দরবারে। দ্বিতীয় দিন সিলেট শহীদ শামসুদ্দিন হাসপাতালে ভর্তি হলেন,জানিনা ডাক্তার মঈন উদ্দিন নিজেকে নিয়ে কি ভেবেছিলেন। তবে তার অগণিত শুভাকাঙ্ক্ষী প্রিয়জনের মতো আমি নিজেও বিশ্বাস করতাম তিনি সুস্থ, হবেন ফিরে আসবেন পুরনো গতিতে।

আশার প্রদীপ নিভিয়ে দিতে আচমকা ধমকা হাওয়া বয়ে গেল, যখন বলা হলও খুবই দ্রুত অন্যত্র বা ঢাকায় স্থানান্তর করতে হবে।
নিস্তেজ শরীর নিয়ে সংগ্রাম করে ঢাকায় গেলেন, সিদ্ধান্ত নিতে হয়তো বড্ড দেরী হয়ে গেল। মহান আল্লাহর দরবারে তার প্রিয়জনদের আর্তনাত পরম করুণাময়ের কৃপা চাওয়া ছাড়া, সাহায্য চাইবার যায়গা কোথায়?

সিলেট থেকে ৮ই এপ্রিল তাকে ঢাকায় নেয়া হলও, ১৩ ই এপ্রিল ঢাকা কুর্মিটুলা জেনারেল হাসপাতালে লাইফ সার্পোটে শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটলো । তিনি যদি ভেন্টিলেশনের পর্যাপ্ত সাপোর্ট সিলেটে ৭ বা ৮ই এপ্রিল পেতেন হয়তো বা তিনি বেঁচে থাকতেন সেটা তার অগণিত শুভাকাঙ্ক্ষীর ধারণার কথা বলছি।

বিশ্বাস করুণ এই কয়’টা দিন খাওয়া ঘুম ঠিক মতো হচ্ছিল না। ফেইসবুক টিভি স্ক্রিনের দিকে চেয়ে থাকতাম প্রতিটা মূহুর্ত, বার বার মনে হতো এই প্রিয় মানুষটির সুস্থতার ভালো কোন খবর পাবো। আমার মতো নিশ্চয়ই তার পরিবার আত্মীয় বন্ধু স্বজন অগণিত ছাত্র শিক্ষক তার সমস্ত অনুস্বারই গুণগ্রাহী এভাবেই হয়তো অধির ছিলেন।

কে জানতো ১৫ই এপ্রিল সকালটা হবে আমাদের জন্য এতো কান্না বেদনা শোকের। সকালে ঘুম থেকে ওঠে মোবাইল অন করছিলাম আর ভাবছিলাম স্নেহাস্পদ ডাক্তার রায়হানকে ফোন করে ডাক্তার মঈন মামার খুঁজ নেব। মোবাইল অন করেই ডাক্তার রায়হানকে ফোন দিতেই, নিজাম ভাই বলে সে আর কথা বলতে পারছিল না তার কণ্ঠ আড়ষ্ট হচ্ছিল। আমার হাত থেকে মোবাইলটাও খসে পড়লো। টিভি অন করলাম স্ক্রলে লেখা ভাসছে ডাক্তার মঈন উদ্দিন মারা গেছেন অঝোরে কান্না আসলো, জল গড়ালও চোখ বেয়ে। আমার কান্না দেখে স্ত্রী সন্তানরা কিছু না বুঝেই তারাও কান্না শুরু করলো। হে আল্লাহ তোমার এ কেমন বিচার? কেন এতো অকালে চলে যেতে হলও ডাক্তার মঈন উদ্দিনের মতো মহৎপ্রাণ?

তাঁর এই মৃত্যু মেনে নিতে পারেনি লক্ষ কোটি মানুষ, রাষ্ট্রের কাছে ক্ষোভ আছে অনেকের, প্রকাশ করেছেন সবাই। ক্ষোভের সঙ্গত ন্যায্য কারণও নিশ্চয়ই আছে ? উত্তর হয়তো কোন দিন মিলবে না। উত্তরের প্রয়োজনও আজ কেউ অনুভব করছে না।

ডাক্তার মঈন উদ্দিন করোনা ভাইরাস সংক্রমণে আক্রান্ত হওয়ার রিপোর্ট পেলেন ৫ই এপ্রিল সন্ধ্যায়, ১৫ই এপ্রিল ভোর ৬.৪৫মিনিটে ইন্তেকাল। মাত্র কয়টা দিন, চোখের পলকেই যেন তিনি কেমন করে হারিয়ে গেলেন অবিশ্বাস্য ভাবে। সকল প্রিয়জনের দৃষ্টি সীমার বাহিরে চীর দিনের জন্য, অনন্ত-পথে। ৬ই এপ্রিল আমাদের এলাকার তিনির এক নিকট আত্মীয়কে ফোন করে ১০,০০০টাকা পৌঁছে দিলেন তার গ্রামের হত-দরিদ্র কয়টা পরিবারকে। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া গরীব মেধাবী বেশ কতজন ছাত্রের পড়ালেখার যাবতীয় ব্যয় তিনিই বহন করতেন।

অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত আর্থিক সহায়তা করতেন। অতি নীরবে কতজনকে সহায়তা করেছেন, সাক্ষীও রাখেননি কাউকে সহায়তা করতে। বহুগুণের সমন্বয়ে একজন পরিপূর্ণ দেশপ্রেমিক মানুষ ছিলেন, বেঁচে থাকলে তার জন্য সিলেটবাসী সম্মানিত হতো। দেশকে এগিয়ে নিতে তার ভূমিকা এলাকাবাসীকে সমৃদ্ধ করতো। এমন মানুষ সমাজে আজকাল হয় না, আমাদের সমাজে শত বছরেও একজন ডাক্তার মঈন উদ্দিন জন্মায় না।

তার জন্ম কর্ম অগণিত সৃষ্টি কীর্তির মাঝে, সার্থক তার পূর্ণতা । তার চলে যাওয়া আমাদের জন্য বিস্ময়কর বেদনা শোকের হলেও, তিনির জন্য নিশ্চয়ই ছিল পরম গৌরবের।

পুরো পৃথিবীর মানুষ লকডাউনে গৃহবন্দী, তা না হলে এত দিনে বাংলাদেশ সহ বিশ্বের অনেক দেশে শতাধিকের উপরে তার স্মৃতি স্মরণে শোকসভার আয়োজন হতো।

শহীদ ডাঃ মঈন উদ্দিনের মৃত্যুর দুই দিন পর তার জন্ম কর্ম স্মৃতি নিয়ে আমার একটা ছোট্ট লিখা ফেইসবুকে বা অনেক অনলাইন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। লেখাটি চুয়াডাঙ্গা জর্জ কোর্টের একজন স্বনামধন্য প্রবীণ আইনজীবী আব্দুস সালামের ( ভিপি৭০/৭১ চুয়াডাঙ্গা কলেজ) চোখে পড়ে তিনি হৃদয়-মিশ্রিত ভালোবাসায় ডাঃ মঈন উদ্দিনকে শ্রদ্ধা জানালেন। আমি খুবই আপ্লোত হয়ে ভদ্রলোককে ফোন দিলাম তিনির কুশলাদি জানলাম, এবং তিনি ডাক্তার মঈন উদ্দিনকে নিয়ে ফেইসবুকে হৃদয়-স্পর্শী মন্তব্য করেছেন তাই জানতে চাইলাম, তিনি কি ডাক্তার মঈন সাহেবকে চিনতেন? আবেগ তাড়িত হয়ে তিনি বলেছিলেন সবাইকে চিনতে হয় না, কিছু মানুষকে চিনতে হয় অনুভূতি দিয়ে। তিনি বলছিলেন মিডিয়া এবং আপনার (আমার) লেখা থেকে যা মনে হলও ডাক্তার মঈন ছিলেন এদেশের প্রাণ। তিনি অসহায় অধিকার বঞ্চিত মানুষের অনুভূতি বুঝতেন বলেই তিনি ছিলেন গরীবের ডাক্তার, তিনি ছিলেন মানবিক গুণের অধিকারী সকলের কাছে পরম প্রিয় মানুষ। তাইতো তার মৃত্যুর পরে তার স্মরণে লক্ষ কোটি মানুষ ছিল অশ্রুসি

লেখক মোঃ নিজাম উদ্দিন,
সাবেক চেয়ারম্যান খুরমা (উত্তর) ইউনিয়ন পরিষদ, ছাতক।
যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সুনামগঞ্জ জেলা বিএনপি।

Comments are closed.