• সেপ্টেম্বর ৮, ২০২০
  • জাতীয়
  • 482
ই-ভ্যালির বিরুদ্ধে প্রতারণার সত্যতা মিলেছে, তদন্তে ৭ সংস্থা

নিউজ ডেস্কঃ ডিজিটাল বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ই-ভ্যালির বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ ওঠায় প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম নিয়ে ইতোমধ্যে তদন্ত করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। প্রাথমিক তদন্তে ই-ভ্যালির কার্যক্রমে প্রতারণা, জালিয়াতি এবং সময়মতো পণ্য সরবরাহ না করাসহ নানা অনিয়মের সত্যতা পেয়েছে তদন্ত কমিটি। এবার ই-ভ্যালির পুরো কার্যক্রম অধিকতর খতিয়ে দেখতে সরকারের সাত সংস্থাকে চিঠি দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

সংস্থাগুলো হচ্ছে- দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ), জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ এবং জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, ‘ই-ভ্যালির বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ ওঠায় প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম খতিয়ে দেখতে গত ২৫ আগস্ট এফটিএ অনুবিভাগের যুগ্মসচিব মো. আবদুছ সামাদ আল আজাদকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এ কমিটি তাদের তদন্ত প্রতিবেদন গত বৃহস্পতিবার (৩ সেপ্টেম্বর) বাণিজ্য সচিব ড. জাফর উদ্দীনের কাছে হস্তান্তর করেছে। তদন্ত কমিটি ই-ভ্যালির কার্যক্রমে প্রতারণা, জালিয়াতি এবং সময়মতো পণ্য সরবরাহ না করাসহ নানা অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে অধিকতর তদন্তের জন্য গত রোববার চিঠি দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।’

দুদক সচিবের কাছে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে প্রাপ্ত অভিযোগ পর্যালোচনা করে দেখা যায়, নিবন্ধনকালে কোম্পানিটির অনুমোদিত মূলধন ছিল পাঁচ লাখ টাকা। কোম্পানিটি ২০১৯ সলের ১১ নভেম্বর ঢাকা ব্যাংক লিমিটেড কোনাবাড়ী শাখা থেকে ৯০ লাখ টাকা ঋণ নেয় এবং ২০২০ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি তাদের অনুমোদিত মূলধন পাঁচ লাখ টাকা থেকে এক কোটি টাকায় বৃদ্ধি করে।

‘এছাড়া প্রতারণা, জালিয়াতি এবং সময়মতো পণ্য সরবরাহ না করাসহ নানা বিষয়ে ই-ভ্যালি জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। অভিযোগের ধরন বিবেচনায় এটি দুদক সংশ্লিষ্ট বিধায় দুর্নীতি দমন কমিশন আইন ২০০৪ এর প্রযোজ্য ধারা ও বিধি-বিধানের আলোকে এ সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম গ্রহণ করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে অবহিত করার জন্য অনুরোধ করা হলো।’

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যানের কাছে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে প্রাপ্ত অভিযোগ পর্যালোচনা করে দেখা যায়, নিবন্ধনকালে ২০১৮ সালে কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন পাঁচ লাখ টাকা হলেও ২০২০ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি পরিশোধিত মূলধন এক কোটি টাকায় উন্নীত করা হয়। অভিযোগের ধরন বিবেচনায় এটি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সংশ্লিষ্ট বিধায় ‘দ্য ইনকাম ট্যাক্স অর্ডিন্যান্স, ১৯৮৪’ এর প্রযোজ্য ধারা ও বিধি-বিধানের আলোকে এ সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম গ্রহণ করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে অবহিত করার জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিবের কাছে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছে, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে প্রাপ্ত অভিযোগ পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ই-ভ্যালি ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মে অস্বাভাবিক হারে অফার দেয়, যা ই-ইন্ডাস্ট্রির জন্য ক্ষতিকর। এছাড়া এসএমএস, ই-মেইল, কল সেন্টারে ই-ভ্যালির সঙ্গে যোগাযোগ করলেও তারা এ বিষয়ে সাড়া দেয় না।

‘প্রাপ্ত অভিযোগ থেকে জানা যায়, ই-ভ্যালি প্রতিষ্ঠানটি প্রতারণার সঙ্গে জড়িত। অভিযোগের ধরন বিবেচনায় এটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট বিধায় ‘ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট, ২০১৮’ এর প্রযোজ্য ধারা ও বিধি-বিধানের আলোকে এ সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম গ্রহণ করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে জানানোর জন্য অনুরোধ করা হলো।’

জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের মহাপরিচালকের কাছে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছে, ই-ভ্যালির বিরুদ্ধে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে দাখিলকৃত অভিযোগ পর্যালোচনা করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় একটি প্রাথমিক তদন্ত কার্যক্রম সম্পাদন করে। প্রাপ্ত অভিযোগ পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ই-ভ্যালি কাস্টমারদের কাছ থেকে পণ্যের অর্ডার গ্রহণ করলেও প্রতিশ্রুত সময়ে পণ্য ডেলিভারি দিতে ব্যর্থ হয়। ১৫ দিনের মধ্যে পণ্য ডেলিভারি দেয়ার নিয়ম থাকলেও ক্রেতারা দিনের পর দিন অপেক্ষা করে এক মাস, দুই মাস পরও পণ্য বুঝে পাচ্ছেন না। ক্রেতারা ই-ভ্যালিতে অগ্রিম মূল্য পরিশোধ করলেও পণ্যের অর্ডার বাতিল করে পণ্যটি স্টকে নেই মর্মে ই-ভ্যালি থেকে জানানো হয়।

‘পরবর্তীতে ই-ভ্যালি ক্যাশ ব্যাকের টাকা তাদের ওয়ালেটে যুক্ত করে দেয়, যা শুধু ই-ভ্যালি থেকে পণ্য কেনাকাটায় ব্যবহার করা যায়। এছাড়া ক্রেতাদের কাছে সঠিক পণ্য সরবরাহ করা হয় না। অভিযোগের সমর্থনে কোনো কোনো গ্রাহকের ইনভয়েস নম্বর উল্লেখ করা হয়েছে। অভিযোগের ধরন বিবেচনায় এটি জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর সংশ্লিষ্ট বিধায় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯ এর প্রযোজ্য ধারা ও বিধি-বিধানের আলোকে এ সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম গ্রহণ করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে অবহিত করার জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।’

বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের চেয়ারপারসনের কাছে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে প্রাপ্ত অভিযোগ পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ই-ভ্যালি ক্রেতাদের নজর কাড়া সব অফার প্রদান করে। যেমন- ৩০০%, ২০০%, ১০০% ক্যাশব্যাক অফার ইত্যাদি। এসব লোভনীয় অফারের কারণে ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মের সুস্থ চর্চা ব্যাহত হয়েছে। এছাড়া ক্রেতাদের কাছে সঠিক পণ্য সরবরাহ করা হয় না। অভিযোগের সমর্থনে কোনো কোনো গ্রাহকের ইনভয়েস নম্বর উল্লেখ করা হয়েছে। অভিযোগের ধরন বিবেচনায় এটি বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন সংশ্লিষ্ট বিধায় প্রতিযোগিতা কমিশন আইন, ২০১২ এর প্রযোজ্য ধারা ও বিধি-বিধানের আলোকে এ সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম গ্রহণ করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে অবহিত করতে বলা হলো।

এছাড়া মানি লন্ডারিং সম্পর্কিত কিছু আছে কি না, তা বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএফআইইউকে তদন্ত করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে জানাতে বলা হয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাণিজ্য সচিব ড. জাফর উদ্দীন বলেন, ‘ই-ভ্যালির কার্যক্রম বিশেষভাবে খাতিয়ে দেখতে সরকারের বিভিন্ন সংস্থাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এসব সংস্থার তদন্ত প্রতিবেদনে যদি অনিয়ম প্রমাণিত হয় তাহলে প্রচলিত আইন অনুযায়ী ই-ভ্যালির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

সূত্র জানায়, দেশে ই-বাণিজ্যের প্রসার ঘটাতে চাচ্ছে সরকার। সম্প্রতি ডিজিটাল বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ই-ভ্যালির বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ উঠেছে। ই-ভ্যালিসহ ই-বাণিজ্যকে নিয়মের মধ্যে আনতে ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা গত ২৭ আগস্ট নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে ই-বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়মের মধ্যে থেকে কার্যক্রম পরিচালনা করতে বাধ্য করার তাগিদ দেন। ই-বাণিজ্যের প্রসার ঘটাতে গিয়ে যেন কোনো ভোক্তা প্রতারিত না হন, সেদিকে কঠোরভাবে নজরদারি করতে বলা হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানকে নিয়মের মধ্যে থেকে ব্যবসা পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

এদিকে ই-ভ্যালির বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ ওঠায় প্রতিষ্ঠানটিসহ এর চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিন ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. রাসেলের পরিচালিত সব ব্যাংক হিসাব স্থগিত করার নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

গত ২৭ আগস্ট কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অধীন বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) থেকে সব ব্যাংককে চিঠি দিয়ে এ নির্দেশনা দেয়া হয়। চিঠিতে তাদের নামে থাকা সব হিসাব আগামী ৩০ দিন স্থগিত রাখতে বলা হয়েছে। বিএফআইইউ সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।

ব্যাংকগুলোতে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, ই-ভ্যালি লিমিটেডের নামে এবং প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিন, এনআইডি নম্বর-স্মার্ট (২৮০….৭১) ও এমবি মো. রাসেল, এনআইডি নম্বর-স্মার্ট (১৪৮…৪৪) এর নামে পরিচালিত সব হিসাবের লেনদেন মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের ক্ষমতাবলে পত্র ইস্যুর তারিখ থেকে ৩০ দিনের জন্য স্থগিত রাখার নির্দেশনা দেয়া হলো। লেনদেন স্থগিতাদেশের ক্ষেত্রে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ বিধিমালা ২০১৯ এর ২৬ (২) ধারা, বিধান প্রযোজ্য হবে।

এছাড়া বর্ণিত প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিদের নামে পরিচালিত হিসাবসমূহের শুরু থেকে হালনাগাদ লেনদেন বিবরণী এবং বর্ণিত সময়ে ওই হিসাবে ৫০ লাখ বা তার বেশি টাকা জমা ও উত্তোলন সংশ্লিষ্ট তথ্য দলিলাদি পাঠানোর নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।