- ডিসেম্বর ১৪, ২০২১
- মৌলভীবাজার
- 450
মৌলভীবাজার প্রতিনিধিঃ দেশের জন্য লড়াই করেছেন তিনি। যুদ্ধ শেষে পড়ালেখা করে সরকারি চাকরি করেছেন। চাকরি থেকে অবসর নিয়ে দিব্যি ঘুরছেন-ফিরছেন, হাটবাজার ও সংসার করছেন। তবে তিনি জীবিতের তালিকায় নেই। আছেন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার তালিকায়। নিজের নাম জীবিতের তালিকায় ফেরাতে তিনি এখানে-ওখানে ছুটছেন, আবেদন করছেন। এই বীর মুক্তিযোদ্ধার নাম আবদুল হান্নান। বাড়ি মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলার রাজাপুরে।
৭০ বছর বয়সী আবদুল হান্নান বলেন, ১৯৭১ সালে তিনি সিলেটের মুরারি চাঁদ সরকারি কলেজের একাদশ শ্রেণির প্রথম বর্ষের ছাত্র ছিলেন। ছিলেন ছাত্রলীগের কর্মী। এপ্রিলের শেষের দিকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে জকিগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে ভারতের করিমগঞ্জে চলে যান। করিমগঞ্জে ছাত্রলীগ নেতা আখতার হোসেনের সঙ্গে দেখা হয়। এরপর করিমগঞ্জ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আরেক ছাত্রলীগ নেতা মকছুদ ইবনে আজিজ লামার কাছে যান। সেখান থেকে তাঁকে পাঠানো হয় কৈলাসরে। সেখানে তাঁর খালাতো ভাই শহীদ বখত ময়নুসহ পরিচিত আরও অনেকের দেখা পান।
আবদুল হান্নানের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, করিমগঞ্জ থেকে ৪৫ দিনের গেরিলা প্রশিক্ষণের জন্য তাঁকে পাঠানো হয় লোয়ার হাফলং প্রশিক্ষণকেন্দ্রে। প্রশিক্ষণ শেষে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প রাতাছড়ায় ফেরেন। সেখান থেকে তাঁদের একটি দলকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় দেশে। দলটি শ্রীমঙ্গলের সাতগাঁওয়ে পাকিস্তানি সেনাদের ঘেরাওয়ের মুখে পড়ে আবার ভারতে ফিরে যায়। নভেম্বরের দিকে দেশের ভেতর মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় ও প্রশিক্ষণের জন্য একটি ক্যাম্প তৈরি করতে তাঁকেসহ ছয়জনের একটি দলকে পাঠানো হয়। দলের সদস্যরা রাজনগর এসে কাজ শুরু করেন।
একপর্যায়ে তাঁর বাড়ি থেকে তিনিসহ তিনজনকে ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানি সেনারা। তাঁদের মৌলভীবাজার জেলা সদরে পাকিস্তানি সৈন্যদের ব্রিগেড হেডকোয়ার্টার প্রাথমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণকেন্দ্রে (পিটিআই) বন্দী রাখা হয়। প্রায় ২০ দিন পর ছাড়া পান তিনি। তত দিনে রাজনগর মুক্ত হয়ে গেছে। বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করে অনেক সহযোদ্ধা শহীদ হয়েছেন।
আমি আপনার সামনেই আছি। কিন্তু আছি শহীদের তালিকায়। শহীদ ছিফাত মিয়া ও দানু মিয়ার সঙ্গে নাম পাঠানোয় বিপত্তিটা হয়েছে।
আবদুল হান্নান
যুদ্ধ শেষে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে অস্ত্র জমা দেন আবদুল হান্নান। ১৯৭৬ সালে মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়ে তহশিলদার পদে চাকরিতে যোগদান করেন। দীর্ঘ চাকরিজীবন শেষে ২০০৯ সালে অবসরে যান। এখন অবসর যাপন করছেন। ২০১২ সালে তালিকায় নাম ওঠাতে প্রথম মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেন। ২০১৪ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা মাঠপর্যায়ে যাচাই-বাছাইয়ের লক্ষ্যে গঠিত কমিটি তথ্য-উপাত্ত ও কাগজপত্র দেখে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তাঁর নাম তালিকাভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়। সেই তালিকা জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলে পাঠানো হয়।
একপর্যায়ে তিনি জানলেন, তালিকায় নাম ওঠাতে ই-মেইলে আবেদন করতে হবে। তিনি ২০১৭ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি সরাসরি কেন্দ্রীয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদে গিয়ে কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করেন। এর কিছুদিন পরই জানলেন তাঁর নাম জীবিত মুক্তিযোদ্ধা নয়, শহীদ মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় উঠেছে।
এরপর থেকে নিজেকে জীবিত মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত করতে চেষ্টা করে যাচ্ছেন আবদুল হান্নান। সর্বশেষ ২০২১ সালের ১৮ জানুয়ারি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে এ–সংক্রান্ত একটি আবেদন করেন। আবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৪ সালের ১৪ মে রাজনগরে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা মাঠপর্যায়ে যাচাই-বাছাই কমিটির সভায় প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তাঁর নাম ঠিক করা হয়। জেলা প্রশাসকের কাছে যে চিঠি পাঠানো হয়, সেখানে ‘শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের আবেদন যাচাই’ কথাটা লেখা হয়েছে। জেলা প্রশাসনও একই তালিকা মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলে পাঠায়। ফলে শহীদের তালিকাতেই থেকে যায় তাঁর নাম।
এর আগে ২০১৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি যাচাই-বাছাই কমিটির সামনে উপস্থিত হয়ে বক্তৃতা করেন আবদুল হান্নান। পরে জানতে পারেন শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় তাঁর নাম পাঠানোর কারণে জীবিত মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম ওঠানোর আর প্রস্তাব করা হয়নি।
গতকাল সোমবার আবদুল হান্নান এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমি আপনার সামনেই আছি। কিন্তু আছি শহীদের তালিকায়। শহীদ ছিফাত মিয়া ও দানু মিয়ার সঙ্গে নাম পাঠানোয় বিপত্তিটা হয়েছে। কেন্দ্র আমার নাম শহীদ ধরেই তালিকাভুক্ত করেছে। আলাদা করে পাঠালে এই সমস্যাটা হতো না।’ শহীদের তালিকা থেকে জীবিত মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্তি ও মুক্তিযোদ্ধার যথাযথ মর্যাদার দাবি জানিয়েছেন তিনি।
মুক্তিযোদ্ধা সংসদ রাজনগর উপজেলার সাবেক কমান্ডার সজল কুমার চক্রবর্তী বলেন, বিষয়টি সমাধানের জন্য ইউএনওর সঙ্গে কথা বলা হয়েছে। গত সপ্তাহে বিষয়টি জেনেছেন বলে উল্লেখ করে ইউএনও প্রিয়াংকা পাল বলেন, ‘এই সপ্তাহের মধ্যেই মূল ঘটনা উল্লেখ করে ডিসি স্যারের মাধ্যমে মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন পাঠাব।’