• সেপ্টেম্বর ৪, ২০২২
  • জাতীয়
  • 236
যুবদলকর্মী শাওনের ইটের জবাবে পুলিশের রাইফেলের গুলি

নিউজ ডেস্কঃ নারায়ণগঞ্জে বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে পুলিশের গুলি করার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্নের মধ্যে একটি ভিডিও পাওয়া গেছে, যেখানে দেখা যাচ্ছে শাওন প্রধান পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুড়ছেন। অন্যদিকে গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা সরাসরি তাকে গুলি করেন।

বিএনপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আনন্দ আয়োজন থেকে হঠাৎ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন নেতাকর্মীরা। টানা কর্মসূচিতে থাকা দলটি বিক্ষোভ আরও বাড়িয়েছে। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ চলছেই।

গত ৩১ জুলাই ভোলায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে দুইজনের প্রাণহানির ঘটনায় বিএনপির মধ্যে এমনিতে দানা বাঁধছিল ক্ষোভ। এর মধ্যে ১ সেপ্টেম্বর দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে নারায়ণগঞ্জে মিছিলে বাধার পর পুলিশের গুলিতে একজনের প্রাণহানি বাড়িয়েছে ক্ষোভের মাত্রা।

প্রশ্ন উঠেছে, পুলিশ সেদিন অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ করেছিল কি না, সেখানে গুলি না করেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা যেত কি না।

সেদিনের যে নানা ছবি ও ভিডিও পাওয়া গেছে, তাতে দেখা গেছে বিএনপির নেতাকর্মীরা ইটপাটকেল ছুড়ছেন। অন্যদিকে পুলিশকে, এমনকি গোয়েন্দা পুলিশের সদস্যদের বিএনপি নেতাকর্মীদের দিকে সরাসরি গুলি চালাতে দেখা গেছে।

ভিডিওতে শাওনের লুটিয়ে পড়ার দৃশ্য

সেদিনের একটি ভিডিওতে দেখা গেছে ২নং গেট এলাকায় পুলিশ বক্সের পাশেই একজন গোয়েন্দা পুলিশ সদস্য চায়নিজ রাইফেল থেকে গুলি করছেন। তার পাশে দাঁড়ানো আরেকজন পুলিশ সদস্যের হাতে গুলির ম্যাগাজিন।

পাশে কয়েকজন পুলিশ সদস্য দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাদের মধ্যে একজনের মাথা ফেটে রক্ত পড়ছিল। গুলি লোড করা শেষ হলে ডিবি পুলিশের সেই সদস্য সরাসরি নেতাকর্মীদের দিকে তাক করে গুলি ছুড়তে থাকেন।

সে সময় বিএনপি নেতাকর্মীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুড়ছিলেন। তাদের মধ্যে ছিলেন শাওন প্রধান। কিছুক্ষণ পরই তিনি গুলিবিদ্ধ হন।

বুকে গুলি নিয়ে শাওন হেঁটে দেওভোগের গলিতে ঢোকেন। কিছুটা সামনে গিয়ে মাটিতে পড়ে যান। তখন বিএনপি নেতারা তাকে কোলে নিয়ে এগোতে থাকেন। এরপর গলির সড়ক ধরে তাকে হাসপাতালে নেয়া হয়।

চায়নিজ রাইফেল থেকে গুলি করার মতো পরিস্থিতি ছিল কি?

জেলা পুলিশের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানান, পুলিশের সঙ্গে বিএনপি নেতাদের সংঘর্ষে টিয়ার শেল, শটগান থেকে রাবার বুলেট, সাউন্ড গ্রেনেডের পাশাপাশি চায়নিজ রাইফেল ব্যবহার করা হয়েছে।

এই কর্মকর্তা জানান, চায়নিজ এসএমজি সেভেন পয়েন্ট সিক্স টু রাইফেল বড় ধরনের কোনো সংঘাত হলে ব্যবহার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

চায়নিজ রাইফেল ব্যবহারের মতো পরিস্থিতি ছিল কি না- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘জানমাল ও সরকারি সম্পদ রক্ষায় পুলিশ আইন মেনে গুলি করতে পারে। তবে এখানে যে পরিস্থিতি হয়েছে তাতে কে গুলি করার অনুমতি দিয়েছে তা আমার জানা নেই।’

ইটপাটকেলের বদলে রাইফেল ব্যবহার করা সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল কি না, জানতে চাইলে নারায়ণগঞ্জ পুলিশ সুপার গোলাম মোস্তাফা রাসেল কোনো জবাব দেননি। প্রশ্ন শুনেই অন্য আরেক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলে ফোন কেটে দেন তিনি।

পরে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আমির খসরুর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন ধরেননি।

ঘটনাস্থলে থাকা নারায়ণগঞ্জের সদর মডেল থানার পরিদর্শক সাইদুজ্জামান জানিয়েছিলেন রাবার বুলেটসহ ছয় শতাধিক গুলি করা হয়েছিল সেদিন।

সেদিন কী হয়েছিল

বিএনপির ৪৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে পূর্বঘোষিত সমাবেশে যোগ দিতে বৃহস্পতিবার সকাল থেকে বঙ্গবন্ধু সড়কের ২ নম্বর রেলগেট এলাকার চুনকা পাঠাগারের সামনে জড়ো হতে থাকেন মহানগর বিএনপিসহ এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে মিছিল বের করতে গেলে বাধার মুখে পড়েন তারা।

কথা-কাটাকাটির একপর্যায়ে পুলিশ তাদের লাঠিপেটা করলে শুরু হয় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া। পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকেন নেতাকর্মীরা। এ সময় পুলিশবক্স ভাঙচুর করা হয়।

পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে রাবার বুলেট ও কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে। এ সময় চায়নিজ রাইফেল থেকে সরাসরি গুলি করেন একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা। শাওন প্রধান গুলিবিদ্ধ হলে হাসপাতালে নেয়ার আগেই তার মৃত্যু হয়। তিনি যুবদল কর্মী জানিয়ে এই ঘটনার প্রতিবাদে দেশজুড়ে বিক্ষোভ দেখাচ্ছে বিএনপি।

প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা

একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, বঙ্গবন্ধু সড়কের ডিআইডি বাণিজ্যিক এলাকা দিয়ে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বিএনপির একটি মিছিল আসে। মিছিলটি ২নং রেলগেট এলাকায় গেলে বাধা দেয় পুলিশ।

সেখানে জেলা বিএনপির আহ্বায়ক মনিরুল ইসলাম রবি পুলিশকে বোঝানোর চেষ্টা করেন যে তারা সরে যাবেন। সেখানে আলোচনা শেষে বিএনপির নেতাকর্মীরা সড়কের পশ্চিম পাশে গিয়ে অবস্থান করেন। সেখান থেকেও তাদের চলে যেতে বলে পুলিশ।

সেখানে জেলা বিএনপির নেতাদের সঙ্গে যখন পুলিশের কথা হচ্ছিল, সে সময় ২নং গেটের দিকে একটি মিছিল আসে। তখন পুলিশ বাঁশি বাজিয়ে লাঠিপেটা শুরু করে।

ধাওয়া খেয়ে নেতাকর্মীরা বিভিন্ন অলিগলিতে অবস্থান করে পুলিশকে উদ্দেশ করে ইটপাকেল ছুড়তে থাকেন। পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ছুড়ে জবাব দেয়। হঠাৎ শুরু হয় গুলি।

ঘটনাস্থলে থাকা দোকানি আব্দুর রহমান বলেন, ‘দেখলাম মিছিল আসল। তারা স্লোগান দিতাছে। তখন দেখি পুলিশ গিয়া তাদের থামাইল। এরপর বাঁশি দিয়া পিটানি শুরু করল। তখন বিএনপির লোকজন না, আশপাশের লোকজন দৌড় দিছে। এরপর পুলিশরা তাগো বক্সের সামনে গেল। ওই দেখি ডিল্লাডিল্লি ও আর ধোঁয়া। এরপর আমি দোকান বন্ধ কইরা একটা হোটেলে গিয়া আশ্রয় নিছি।’

তিনি জানান, সংঘর্ষের একপর্যায়ে বিএনপির নেতাকর্মীরা পুলিশবক্সে হামলা চালান। সে বক্সের পাশে ছিল একটি পত্রিকার দোকান।

ওই দোকানি বলেন, ‘পুলিশের মাথায় বাড়ি দিছে লোকজন। ডিল্লাইতে ডিল্লাইতে এই মাথায় আইসা পড়ছে। তখন পুলিশ পিছে গেছে গা। এরপর আরও পুলিশ যখন আইল, তখন পুরা গোলাগুলি শুরু হইল। ডরে আমি দোকানের শাটার নামাইয়া ভিতরে বইসা ছিলাম। হায়রে গুলির শব্দ!’

ঘটনার সময়ের একাধিক ভিডিওতে দেখা গেছে, বিএনপি নেতাকর্মীরা দেওভোগে মোড়, মরগ্যান স্কুলের গলি, গুলশান হলের গলি, ২নং গেটের মোড়, চেম্বার রোড, ১নং গেট ও মণ্ডলপাড়া এলাকা পর্যন্ত মূল সড়কে ও বিভিন্ন অলিগলিতে অবস্থান নেন।

সেখান থেকে পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুড়তে থাকেন। পুলিশের ধাওয়ায় কিছুটা পিছে যান আবার ফিরে আসেন। তখন তাদের হাতে ছিল লাঠিসোঁটা। সড়কে আগুনও জ্বালান তারা। ভাঙচুর করা হয় যানবাহন।

এভাবে চলতে থাকে দেড় ঘণ্টা। পরে পুলিশ সামনের দিকে গুলি করে এগোতে থাকলে তারা পিছু হটেন।

বিএনপির একাধিক নেতা বলছেন, পরিস্থিতি অনেকটাই স্বাভাবিক ছিল। সেটি অস্বাভাবিক করেছে পুলিশ।

বিএনপি-পুলিশ পাল্টাপাল্টি

জেলা বিএনপির আহ্বায়ক মনিরুল ইসলাম রবি পুরো ঘটনার দায় দিয়েছেন পুলিশকে। তিনি বলেন, ‘আমরা বিগত কয়েক মাস ধরে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি করে আসছি। নগরীর চাষাঢ়া এলাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ও বালুর মাঠ এলাকায় প্রায় সভা সমাবেশ ও বিক্ষোভ করেছি। তখন তো পুলিশ সেখানে ছিল। তারা আমাদের বাধা দিত, লাঠিচার্জ করত, কিন্তু এমন ঘটনা তো ঘটেনি। আমাদের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পণ্ড করতে পুলিশ আগেই পরিকল্পনা করেছে।’

মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর মিছিল ছিল শান্তিপূর্ণ। কিন্তু পুলিশ পরিস্থিতি ঘোলাটে করেছে। কোনো ধরনের উসকানি ছাড়াই মিছিলের পেছন থেকে লাঠিপেটা শুরু করে। এরপর গুলি করতে থাকে।

‘আমাদের শাওন নামের একজন কর্মীকে গুলি করে মেরেছে। আহত করেছে আরও অনেক নেতাকে। এই পরিস্থিতির জন্য বিএনপি নয়, দায়ী পুলিশ।’

তবে পুলিশ বলছে, বিএনপি নেতাকর্মীদের সরে যেতে বলা হয়েছে। কিন্তু তারা না সরে পুলিশের ওপর হামলা করে। বিনা অনুমতিতে সড়কে বিশৃঙ্খলা তৈরি করে।

ঘটনার পরপরই নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার গোলাম মোস্তাফা রাসেল বলেন, ‘আমরা তাদের বারবার রিকোয়েস্ট করে বলেছি যে আপনারা কোনো অনুমতি নেননি। আপনারা যদি সমাবেশ করতে চান তাহলে আপনাদের পার্টি অফিস আছে, সেখানে করেন বা যেখানে আপনাদের ভালো হবে। কিন্তু রাস্তা অবরোধ করা যাবে না। কিন্তু তারা আমাদের কথা প্রত্যাখ্যান করে আমাদের ওপর ইটপাটকেল মারে, ককটেল নিক্ষেপ করে।

‘তারা পুলিশকে উদ্দেশ করে বৃষ্টির মতো ইট মেরেছে। বিভিন্ন অফিস, দোকান ভাঙচুর করেছে। গণতান্ত্রিক দেশে এটা কোনোভাবেই মেনে নেয়া সম্ভব না এবং আমরা আইনগতভাবে তাদের প্রতিহত করেছি।’