• নভেম্বর ১৪, ২০২৩
  • লিড নিউস
  • 211
৪৫ জনের কানাডাযাত্রা বাতিলে সিলেটে তোলপাড়, নেপথ্যে কী?

নিউজ ডেস্কঃ ভুয়া আমন্ত্রণপত্র নিয়ে কানাডা যাওয়ার সময় সিলেটের ৪৫ যাত্রীকে ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকেই ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে গত ৬ নভেম্বর।

রবিবার (১২ নভেম্বর) রাতে বিষয়টি জানাজানির পর সিলেটে তোলপাড় শুরু হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এ ঘটনার পক্ষে-বিপক্ষে চলছে সমালোচনা।

অনুসন্ধানে সিলেট ও কানাডার টরন্টোর কয়েকটি অ্যাজেন্সি মিলে ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে ভিসা করানোর একটি চক্রের খবর পাওয়া গেছে। এই চক্রে সিলেট থেকে সমন্বয় করেন কানাইঘাট উপজেলার বীরদল গ্রামের ডা. নাজমুলের ছেলে এনামুল হক মাসুম। কানাডা থেকে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে ভুয়া আমন্ত্রণপত্র দিয়ে ভুয়া কাগজপত্রের মাধ্যমে ভিসা করিয়ে দেন এনামুল হক মাসুমের ভগ্নিপতি কামরুল হাসান সাহান।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কানাডার টরন্টোর বাসিন্দা মালেকা নাসরিনের যে মেয়ের বিয়েতে অংশ নিতে কানাডায় যাচ্ছিলেন ওই ৪৫ যাত্রী, সেই মেয়ের বিয়ে হয়েছে আরও একবছর আগে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে টরন্টোর এক বাসিন্দা বলেন, মালেকা নাসরিনের মেয়ের বিয়ে হয়েছে আরও এক বছর আগে। এখন কোনো বিয়ে এখানে হচ্ছে না। তারা নিজেদের লাভের জন্য একটি চক্র তৈরি করেছে। যেখানে ভুয়া ডকুমেন্ট দিয়ে বাংলাদেশ থেকে কানাডায় মানুষ আনেন।

জানা যায়, বিমানবন্দর থেকে ফেরত আসা কানাডা যেতে চাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে কেউই বৈধ্য কোনো অ্যাজেন্সির মাধ্যমে ভিসা প্রসেসিং করাননি। কানাইঘাট উপজেলার বীরদল গ্রামের ডা. নাজমুলের ছেলে এনামুল হক মাসুম এই ভুয়া ভিসা প্রসেসিংয়ের সাথে যুক্ত। কানাডায় ভিসা প্রসেসিংয়ের ব্যাপারে র্দীঘদিন ধরে তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি ফেসবুক আইডি থেকে প্রচার প্রচারণা করে আসছিলেন।

গত ২৮ অক্টোবর তিনি তার ফেসবুকের একটি পোস্টে লিখেন, ‘আলহামদুল্লিলাহ…. মহান রবের দরবারে লাখো শুকরিয়া আজ মোট ০৮টিসহ, সর্বমোট ১৭১টি কানাডিয়ান ভিজিট ভিসার গর্বিত অংশীদার হয়ে থাকলাম…’।

এর আগে গত ৬ অক্টোবর ২৫ জনকে কানাডায় পাঠান এনামুল হক মাসুম। দুই দফায় ৩৩ জনকে নিরাপদে কানাডায় পৌঁছানোর জন্য এনামুল নিজেও তাদের সঙ্গে সফর করেছেন।

এ দিকে, ৪৫ যাত্রীকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকেই ফিরিয়ে দেওয়ার পর গাঁ ঢাকা দিয়েছেন এনামুল হক মাসুম। তার ফেসবুক আইডিটি ডিএ্যাক্টিভেট করে রাখা হয়েছে। তার মোবাইল ফোনও বন্ধ।

কানাইঘাটের বীরদল গ্রামে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বর্তমানে এলাকার প্রায় সবাই জানে এনামুল হক মাসুম কানাডায় লোক পাঠান। জনপ্রতি ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকার চুক্তিতে ভিসা হওয়ার পর তিনি গ্রাহকদের কাছ থেকে টাকা নেন। সম্প্রতি তিনি ৩৩ জনকে কানাডায় পাঠানোর পর স্থানীয়দের তার উপর বিশ্বাস বাড়তে থাকে। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে তিনি তার দুলাভাই কানাডা প্রবাসী কামরুল হাসান সাহানের মাধ্যমে ভুয়া ভিসা প্রসেসিংয়ের কাজ শুরু করেন।

এর আগেও লন্ডনে পাঠানোর কথা বলে এনামুল হক মাসুম স্থানীয়দের কাছ থেকে কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কানাইঘাটের কয়েকজন জানান, এনামুল হক মাসুমের আদম ব্যবসা নতুন কিছু না। ২০০৫ সালে যখন লন্ডনে ওর্য়াক পারমিট ভিসার সুযোগ দেওয়া হয় তখন সে লন্ডন ছিল। সেখান থেকে সে লন্ডনে লোক নিবে বলে স্থানীয়দের কাছ থেকে ২৫ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন। তখন এ ধরনের অবৈধ কাজের জন্য ১০ বছরের জন্য তাকে কালো তালিকাভূক্ত করে লন্ডন।

এ ব্যাপারে জানতে এনামুল হক মাসুমের ফোনে কল দিলে তা বন্ধ পাওয়া যায়। পরবর্তীতে হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, ‘এই ভিসাগুলো করা হয়েছে ইনভাইটেশন (আমন্ত্রণপত্র) দিয়ে। সঠিক অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য সঠিক ভিসা থাকার পরও আমাদের যাত্রীদের আটকানো হয়েছে। বিমান কর্তৃপক্ষ এখন নিজেদের বাঁচানোর জন্য ভুয়া আমন্ত্রনপত্র, হোটেল বুকিং না থাকাসহ নানা অজুহাত দেখাচ্ছে। কারণ বাংলাদেশ বিমান টিকিটের দেড় কোটি টাকা লস করেছে। সিলেট থেকে যাত্রীদের ছাড়ার পর ঢাকা বিমানবন্দরের অফিসার মিজানুর রহমান যাত্রীদের আটকে দেয়। মূলত বিমানের কিছু কর্মকর্তা সিলেট বিদ্বেষী। তাদের কোনো আত্মীয় স্বজন যেতে পারে না কিন্তু সিলেটিরা প্রতিনিয়ত বিমান ভরে ভরে যাচ্ছে এটা তারা মানতে পারে না। তাই এই যাত্রীদের আটেকে তারা তাদের সিলেট বিদ্বেষী মনোভাবে বর্হিপ্রকাশ করেছে।’

ফেরত ৪৫ জনের সবার ভিসা তার মাধ্যমে হয়নি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এর আগে আমি আর কাউকে কানাডা পাঠাইনি। এ বিষয়ে আমার জানা নেই।’

ঘটনাটি জানাজানি হলে একটি সিন্ডিকেট প্রচারণা শুরু হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিমান বাংলাদেশের কর্মকর্তাদের ‘সিলেট বিদ্বেষী’ বলা হচ্ছে।

আবার কেউ কেউ অভিযোগ তুলছেন, আর্থিক লেনদেনে বনিবনা না হওয়ায় এ ঘটনাটি ঘটেছে।

তবে এ প্রসঙ্গে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স সিলেটের ডেপুটি স্টেশন ম্যানেজার শাকিল আহমদ বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে যত যাত্রী যান সবাই আমাদের কাছে ভিআইপি। আমাদের কাছে ওয়ার্কার, ব্যবসায়ী সবাই সমান। কেউ আমাদের শত্রু নয়। কারো সাথে বিদ্ধেষমূলক আচরণ করে তাদেরকে বিব্রত করবো এ ধরনের মানিসকতা আমাদের কারও নেই। তাছাড়া যাত্রী অফলোড আমাদের একক কোনো অথরিটির নেই। এটার সমস্ত কিছু করে যে দেশে যাত্রী যাবে সে দেশের হাইকমিশন।’

৪৫ জন যাত্রী ফেরত পাঠানোর বিষয়ে ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘যাত্রীদের অফলোড করা হয়েছে কারণ উনাদের যে ইনভাইটেশন লেটার ছিল সেখানে লেখা ছিল হোটেল বুকিং। কিন্তু উনারা দেখাচ্ছেন ওইখানের রেনটেড হাউস। কানাডিয়ান বর্ডার ফোর্স আমাদের জানায় তাদের সরকারি আইন অনুযায়ী একটি রেনটেড হাউসে ৩২ জন বা ৪৫ জন থাকার কোনো নিয়ম নেই। এর আগেও যাত্রীদের এ রকম সমস্যার জন্য বিমানকে জরিমানা করা হয়েছে। এখন এজন্য আমাদের ম্যাজেনমেন্ট এ ব্যপারে কনর্সান। ভিসা, ইনভাইটেশন থাকলে যাত্রী যাবেন। এখন আমরা কিভাবে বুঝব যাত্রীর ডকুমেন্ট সঠিক না ভুয়া। তাই কোনো যাত্রীর ব্যাপারে সন্দেহ হলে আমাদের পাসপোর্ট কন্টোল ইউনিট (পিসিও) যেটা করে সেটা হলো, বর্ডার ফোর্সের কাছে যাত্রীদের সব ডকুমেন্ট পাঠায়। তখন বর্ডার ফোর্স পিসিওকে যে ইনস্ট্রাকশন দেয় সে অনুযায়ি তারা কাজ করে। কারো ব্যপারে সন্দেহ হলে এ ধরনের ইনকোয়ারি করা হয়। ওই ফ্লাইটেতো কানাডার আরও অনেক যাত্রী ছিলেন সবাইকেতো অফলোড করা হয়নি। এখন এই ৪৫ জনের পাসপোর্ট ডিটেলসসহ সব ডকুমেন্ট পিসিওর মাধ্যমে কানাডিয়ান বর্ডার র্ফোসে পাঠানো হয়েছে। তারা ভেরিফিকেশন করে যা পাঠাবে ফাইনালি যাত্রীদেরকে আমরা জানিয়ে দেব ভিসা ঠিক আছে কি না। এ ব্যাপারে কানাডিয়ান হাই কমিশন এখনো কিছু জানায়নি। তারা পারমিশন দিলে ওই ৪৫জন যেতে পারবেন।’

অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল অ্যাজেন্টস অব বাংলাদেশ (আটাব) ঘটনাটি সিলেটের জন্য লজ্জাজনক বলে অভিহিত করছে।

সংস্থাটির সিলেট জোনের চেয়ারম্যান মো. জিয়াউর রহমান খান রেজওয়ান বলেন, ‘ঘটনাটি আমাদের সিলেটের জন্য খুবই লজ্জাজনক ঘটনা। যে বা যার অ্যাজেন্সির মাধ্যমে ভিসা প্রসেসিং করেছেন তারা বৈধ কোনো অ্যাজেন্সি না। এনামুল হক মাসুম নামে কেউ বা কারো প্রতিষ্ঠান আটাবের অর্ন্তভূক্ত নয়। এটা ভুয়া অ্যাজেন্সি। তারমত অনেক মানুষ এখন সিলেটে নামে বেনামে ভুয়া অ্যাজেন্সি খুলে ব্যবসায় নেমেছে। ফেসবুকে তারা শতভাগ গ্যারান্টি সহকারে ভিসা প্রসেসিংয়ের বিজ্ঞাপন দিয়ে মানুষজনকে আকর্ষিত করছে। আর প্রবাসে যেতে আগ্রহীরা কোনো যাচাই-বাছাই না করে তাদের ফাঁদে পা দিচ্ছেন।’

নিরাপদ অভিবাসন বিষয়ে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, ‘একটা চক্র এ রকম আছে যারা সিলেট অঞ্চলের লোকজনকে লন্ডন, আমেরিকা, কানাডা পাঠানোর কথা বলে ভুয়া কাগজপত্রপত্র দিয়ে ভিজিট ভিসা, স্টুডেন্ট ভিসাসহ বিভিন্ন ভিসা প্রসেসিং করে। এই অবৈধ কাজের জন্য যারা বৈধভাবে বিদেশে যায় তাদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। তখন বৈধ্য যাত্রীরা সন্দেহে পড়ে। এতে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়। কাজেই এ ধরনের জেনেশুনে জালিয়াতি করে বিদেশে যাওয়া কোনোভাবেই উচিত না।’