- ডিসেম্বর ১৬, ২০২৩
- জাতীয়
- 193
নিউজ ডেস্কঃ বর্তমান সরকার রাজাকারের তালিকা করার উদ্যোগ নেয়। একবার যেনতেনভাবে তালিকা প্রকাশের পর বিতর্কের মুখে তা স্থগিত করা হয়। কিন্তু এরপর আর এ উদ্যোগ বেশি দূর এগোয়নি। এরই মধ্যে সরকারের মেয়াদ শেষের পথে। চলছে নির্বাচনকালীন সরকার। তাই রাজাকারের তালিকা আপাতত আর হচ্ছে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস দেশের বিভিন্ন এলাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করা ব্যক্তিদের সাধারণভাবে রাজাকার বলা হয়। পাকিস্তানিদের সহযোগী আরও দুটি সংস্থার নাম ছিল আলবদর ও আলশামস। পাকিস্তানিদের নানান অপকর্ম, যেমন: হত্যা, ধর্ষণ, লুট, অগ্নিসংযোগের ক্ষেত্রে সহযোগিতা করেছেন তারা। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পর এত বছর পেরিয়ে গেলেও তাদের তালিকা করা হয়নি।
২০১৯ সালের বিজয় দিবসের আগের দিন প্রকাশ করা রাজাকারের প্রথম তালিকাটি প্রকাশের পর ব্যাপক সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে তা স্থগিত হয়। এরপর একটি নীতিমালার ভিত্তিতে রাজাকারের নির্ভুল তালিকা করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। সংসদীয় উপ-কমিটি করা হয়। নীতিমালা হয়নি। পরে ‘জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল আইন, ২০২২’ সংশোধনের মাধ্যমে রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতাকারীদের তালিকা করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। সেই উদ্যোগও থামকে আছে।
রাজাকারের তালিকার বিষয়ে জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, রাজাকারের তালিকা আপাতত হচ্ছে না। তালিকাটি কী প্রক্রিয়ায় হবে, সেটি এখনো নির্ধারণ করা যায়নি। সঠিকভাবে সিদ্ধান্ত না নিলে কেউ চ্যালেঞ্জ করে বসলে তো মুশকিলে পড়ে যাব। এ বিষয়ে যে সংসদীয় উপ-কমিটি কাজ করছে তারাও তেমন কিছু এখনো করতে পারেনি।
তিনি আরও বলেন, আমরা আবার ক্ষমতায় আসলে পরবর্তী সময়ে এটি নিয়ে কাজ হবে। রাজাকারের তালিকা করার প্রক্রিয়া চলমান থাকলেও আমরা ফলপ্রসূ কিছু করতে পারিনি।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব ইসরাত চৌধুরী বলেন, আমি বেশি দিন হয়নি এ মন্ত্রণালয়ে এসেছি। আমি এ বিষয়ে এখনো কিছু জানি না।
২০১৯ সালে ১৫ ডিসেম্বর ১০ হাজার ৭৮৯ রাজাকারের তালিকা প্রকাশ করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। তবে ঘোষিত তালিকায় অনেক মুক্তিযোদ্ধার নাম রয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান প্রসিকিউটর ও ভাষাসৈনিক গোলাম আরিফ টিপুসহ রাজশাহীর আরও দুই ব্যক্তির নাম রয়েছে ওই তালিকায়, যারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিলেন বলে প্রমাণ রয়েছে। এ নিয়ে সারাদেশে সমালোচনা শুরু হয়।
বিতর্কের মুখে রাজাকারের তালিকা স্থগিত করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। ওয়েবসাইট থেকে তালিকাটি সরিয়ে ফেলা হয়। পরবর্তী সময়ে যাচাই-বাছাই করে তালিকা প্রকাশ করা হবে বলে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়।
এদিকে রাজাকারের তালিকায় মুক্তিযোদ্ধাদের নাম চলে আসায় তখন দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। তিনি তখন বলেছিলেন, এ তালিকা আমরা প্রণয়ন করিনি, প্রকাশ করেছি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে আমরা যা পেয়েছি তাই হুবহু প্রকাশ করেছি।
রাজাকারের তালিকার বিষয়ে গণহত্যা-নির্যাতন ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক ও ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন বলেন, ওগুলো (রাজাকারের তালিকা) আর হবে বলে মনে হয় না। এখন রাজাকার-মুক্তিযোদ্ধা সব মিলেমিশে গেছে।
পরে রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতাকারীদের তালিকা করার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেয় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। এরপর মন্ত্রিসভা বৈঠকের অনুমোদন, জাতীয় সংসদে পাস হওয়ার পর গত বছরের ৭ সেপ্টেম্বর নতুন ‘জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল আইন, ২০২২’ এর গেজেট জারি করা হয়।
আইনের ৬ (ঙ) ধারায় জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের কার্যাবলীতে বলা হয়েছে- ‘১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ মার্চ হইতে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত যাহারা মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস, মুজাহিদ বাহিনী ও পিস কমিটির সদস্য হিসেবে কর্মকাণ্ডে লিপ্ত ছিল বা আধা-সামরিক বাহিনীর সদস্য হিসেবে সশস্ত্র যুদ্ধে নিয়োজিত থাকিয়া বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করিয়াছে বা খুন, ধর্ষণ, লুট, অগ্নিসংযোগের অপরাধমূলক ঘৃণ্য কার্যকলাপ দ্বারা নিরীহ মানুষকে হত্যার মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধ সংগঠিত করিয়াছে অথবা একক বা যৌথ বা দলীয় সিদ্ধান্তক্রমে প্রত্যক্ষভাবে, সক্রিয়ভাবে বা পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করিয়াছে তাহাদের বিদ্যমান তালিকা প্রকাশের পদক্ষেপ গ্রহণ করিবে ও প্রয়োজনে, যথাযথ তথ্যের ভিত্তিতে নূতন তালিকা এবং ১৯৭০ সনের নির্বাচনে যাহারা এমএনএ এবং এমপিএ নির্বাচিত হইয়া পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বন করিয়াছিল এবং বাংলাদেশের পক্ষ অবলম্বনের কারণে শূন্য ঘোষিত আসনে উপনির্বাচনে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক নির্বাচিত এমএনএ এবং এমপিএ-দের তালিকা প্রণয়ন ও গেজেট প্রকাশের জন্য সরকারের নিকট সুপারিশ প্রেরণ।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে জানা গেছে, রাজাকারের তালিকা করতে ২০২০ সালে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় উপ-কমিটিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কোরাম পূর্ণ না হওয়ায় তারা মিটিংয়েই বসতে পারছিলেন না। শেষে গত বছরের (২০২২) এপ্রিলে নতুন সংসদীয় সাব-কমিটি গঠন করা হয়। আগের মতো নতুন সাব কমিটিতেও শাজাহান খান আহ্বায়ক হন। এর অন্য দুই সদস্য হলেন জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ ও আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য এ বি তাজুল ইসলাম। কমিটি উপজেলা পর্যায় থেকে রাজাকারদের নাম সংগ্রহ করছিল।
এ বি তাজুল ইসলাম বলেন, এটি অত্যন্ত জটিল কাজ। আমরা সেখানে সশরীরে সেখানে যাচ্ছি না। আমাদের অন্যের তথ্যের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। উপজেলা পর্যায় থেকে আমরা তথ্য নিচ্ছিলাম। কিন্তু সেখানে এত কোন্দল! সত্যটা লুকিয়ে রাখে, আবার মিথ্যাকে সত্য করে বলে। তৃণমূল পর্যায়ে এই যখন প্রবণতা, সেখানে তথ্যটা বের করা কঠিন। কিন্তু অসম্ভব নয়।
তিনি আরও বলেন, প্রতিটি উপজেলায় সময় দিয়ে জিনিসটা করা সহজ নয়। আমরা যতটা প্রত্যাশা করেছিলাম, ততটা অগ্রগতি হয়নি। কিছুটা কাজ হয়েছে। ‘এটি এমন একটি জটিল কাজ যে, রাজাকারের তালিকা করছি, ভুলেও যেন একটা ভালো লোকের নাম ওখানে না যায়, আবার রাজাকার ছিল তার নাম যেন বাদ না পড়ে। তাই কাজটা দক্ষতা, আন্তরিকতার সঙ্গে এবাদতের মতো করতে হবে’ বলেন সাবেক মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী তাজুল।