- জানুয়ারি ২৫, ২০২৫
- লিড নিউস
- 2
নিউজ ডেস্কঃ পর্যাপ্ত দর না মেলায় একে একে ১৩ বার দরপত্র আহ্বান করা হয় রিয়ার অ্যাডমিরাল এমএ মাহবুব সেতুর। সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কে লামাকাজি এলাকায় সুরমা নদীর ওপর অবস্থিত সেতুটি ১৪তম দরপত্রে ঘটেছে তুঘলকি কাণ্ড।
নামেমাত্র মূল্যে ইজারা দেওয়ায় কোটি কোটি টাকা রাজস্ব গচ্চা গেল সরকারের।
২০২১ সালে ১৮ কোটি ৭২ লাখ টাকায় সেতুটি ৩ সনা বন্দোবস্ত যায়। এবার ইজারা মূল্য এসেছে ৮ কোটি ৫ লাখে এবং ভ্যাট-টেক্সসহ ১০ কোটি ৬ লাখ টাকায়।
সেতুর ইজারা গ্রহিতা মেসার্স মাহি এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন। তিনি বিএনপি নেতা মিজানুর রহমান চৌধুরী গ্রুপের একনিষ্ঠ নেতা বলে জানা গেছে। ওই প্রতিষ্ঠানটিকে ৮ কোটি পাঁচ লাখ ১০ হাজার টাকা এবং ২৫ শতাংশ ভ্যাট যুক্ত করে সর্বমোট ১০ কোটি ৬ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ টাকায় ইজারা দিতে শর্ত সাপেক্ষে অনুমোদন দেওয়া হয়।
এতে সওজ সিলেট জোনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা নিজেদের স্বার্থ হাসিলে সরকারের রাজস্বে বারোটা বাজিয়েছেন। গত ২ ডিসেম্বরের সওজ সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী আমির হোসেন স্বাক্ষরিত এক প্রতিবেদনে সেতুর কাজ আগের বারের চেয়ে ৪৬ দশমিক ২৫ ভাগ কমে দেওয়ার সুপারিশ করা হয়। এই মেয়াদের জন্য প্রতিদিন ৭৩ হাজার ৫২৫ টাকায় দেওয়ার সুপারিশ করা হয়। অথচ আগে প্রতিদিন টোল আদায়ের হার ছিল এক লাখ ৩৬ হাজার ৮০১ টাকা। সর্বোচ্চ দরদাতা হিসেবে মেসার্স মাহি এন্টারপ্রাইজকে আট কোটি পাঁচ লাখ ১০ হাজার টাকার সঙ্গে ১৫ শতাংশ ভ্যাট ও ১০ শতাংশ আয়কর যুক্ত করে সর্বমোট ১০ কোটি ৬ লাখ ৩৭ হাজার ৫শ টাকায় ইজারা দিতে শর্ত সাপেক্ষে অনুমোদন দেওয়া হয়।
সূত্র জানায়, বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আয়ের সেতুটি অনলাইনে টেন্ডারের কথা থাকলেও কৌশলে দু’একটি প্রিন্ট পত্রিকায় টেন্ডার আহ্বান করে সড়ক ও জনপদ বিভাগ সিলেট। সওজ সিলেটের কর্মকর্তাদের পছন্দনীয় একটি প্রতিষ্ঠানকে ইজারা প্রদানে মরিয়া হয়ে ওঠেন। প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নামও গোপনে ঢাকায় পাঠানো হয়। কম মূল্যে ইজারা দিয়ে আগের ইজারা মূল্য ভাগ-বাটোয়ারা করে নেওয়া হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, অনেক বড় বড় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এ সেতুর ইজারায় অংশ নেওয়ার প্রস্তুতি নিলেও সওজ সিলেটের গোপনীয়তার কারণে অংশ নিতে পারেনি। ফলে প্রতিযোগীতাহীনভাবে আগের টেন্ডারের মূল্যের চেয়ে প্রায় ৯ কোটি টাকা কমে ইজারা দেওয়া হয়।
সওজ সিলেটের উপ-বিভাগ সিলেটের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মো. সালাহ উদ্দিন সোহাগ বলেন, আমি এখানে নতুন এসেছি। মাত্র ২০/২২ দিন হয় যোগদান করেছি। সেতুটি ইজারা দেওয়ার বিষয়ে সওজ সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী ভালো বলতে পারবেন।
এ বিষয়ে সিলেট সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী আমির হোসেন বলেন, সেতুটির মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০২৪ সালের ৩০ জুন। ইতোমধ্যে সেতুর টোল আদায় বন্ধ করতে আন্দোলন চলছে। সওজের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা টোল আদায় করতে গিয়ে হেনস্থার শিকার হন। এরইমধ্যে সেতুটি ১৪ বার দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। প্রধান প্রকৌশলীর নির্দেশনা অনুযায়ী শেষবারে ১৪তম (চূড়ান্ত) দরপত্রে সর্বোচ্চ দরদাতাকে ইজারা দেওয়া হয়েছে।
কম মূল্যে ইজারা দেওয়ার কারণ হিসেবে প্রতিবেদনের সুপারিশে বিষয়ে তিনি বলেন, সুনামগঞ্জ জেলার পাগলা-জগন্নাথপুর-আউশকান্দি সড়কের রাণীগঞ্জে কুশিয়ারা নদীর উপর নির্মিত ‘রাণীগঞ্জ’ সেতু চালু হওয়াতে যানবাহন ওই সেতু দিয়ে চলাচল করছে। যে কারণে বর্তমানে বিশ্বনাথ উপজেলার ‘লামাকাজী’ সেতু দিয়ে দিয়ে গাড়ি চলাচল ‘কমে’ গেছে। এজন্য আগের মতো টোল ‘আদায় হচ্ছে না। এ কারণে ইজারার অর্থ অর্ধেকের মতো কমে গেছে।
সেতুটি ইজারার মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার পর আওয়ামী লীগের নেতারা মাত্র ৫ কোটি টাকায় ইজারা নিয়ে টোল আদায় করেছেন এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি তা অস্বীকার করে বলেন, এটা আমি আগে শুনিনি।
স্থানীয়রা জানান, জুলাই থেকে সওজ নিজেই টোল আদায় করছে। বর্তমানে প্রতিদিন ঠিক কত গাড়ি যাচ্ছে এবং কত টাকা টোল উঠছে তার সঠিক হিসাব প্রকাশ করা হচ্ছে না। এখানে ‘অনিয়মের’ গন্ধ রয়েছে।
সেতুর ইজারা গ্রহিতা মেসার্স মাহি এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন রাজু বলেন, ৮ কোটি পাঁচ লাখ ১০ হাজার টাকার সঙ্গে ২৫ শতাংশ ভ্যাট-ট্যাক্সসহ সর্বমোট ১০ কোটি ৬ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ টাকায় ইজারা দিতে শর্ত সাপেক্ষে অনুমোদন দেওয়া হয়। ১৫ জানুয়ারি থেকে টোল আদায়ের জন্য বুঝিয়ে দিয়েছে সওজ।
তিনি বলেন, এ নিয়ে ১৪ বার দরপত্র হয়েছে। ১৪তম বারে তিনি সর্বোচ্চ দরদাতা হয়েছেন। এর আগে অংশ নেওয়া ইজারা প্রতিষ্ঠান ভ্যাট-টেক্সসহ ৯ কোটি ৫৭ লাখ টাকা দর দেন।
এখানে কোনো সিন্ডিকেট হয়নি দাবি করে ইজারাদার আরও বলেন, রাণীগঞ্জ সেতু দিয়ে যানচলাচল শুরু হলে এই সেতুর আয় কমে যায়। এখন ছাতক থেকে মালামাল টানা যানবাহন বেশিরভাগ ওই সেতু ব্যবহার করে। যে কারণে প্রতিদিন ৫০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা আয় কমে গেছে এই সেতুতে। এছাড়া অর্থ বছরের হিসাব করে ১০৯৫ দিন থেকে ১৯৮ দিনের টাকা বাদ দেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে দরপত্রের ৪ কোটি টাকা পে-অর্ডারের মাধ্যমে পরিশোধ করা হয়েছে। অনেকে কম টাকায় নিতে চাচ্ছিলেন। সবকিছু বিবেচনায় দরপত্রে তার দেওয়া সর্বোচ্চ মূল্য বেশি হয়ে গেছে মনে করছেন তিনি। সেতুটি ইজারার মেয়াদোত্তীর্ণের পর আওয়ামী লীগের নেতারা মাত্র ৫ কোটি টাকায় ইজারা নেওয়ার চেষ্টা চালিয়েছিলে শুনেছি।
সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কের বিশ্বনাথ উপজেলার লামাকাজিতে সুরমা নদীর ওপর নির্মিত রিয়ার অ্যাডমিরাল এমএ মাহবুব সেতুতে ১৯৯০ সালের ৩ আগস্ট থেকে টোল আদায় শুরু হয়।
সর্বশেষ ২০২১ সালে ৩ বছরের জন্য ১৮ কোটি ৭২ লাখ টাকায় সেতুটি ইজারা দেওয়া হয়েছিল। চলতি বছরের ৩০ জুন ইজারার মেয়াদ শেষ হয়। ফলে সড়ক ও জনপদ বিভাগ সেতুটি পুনরায় ইজারা দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করে। শেখ হাসিনা সরকার পতনের পরই ২ সেপ্টেম্বর ইজারা আহ্বান করলে মাত্র চারটি প্রতিষ্ঠান অংশগ্রহণ করে। কৌশলে চারটি প্রতিষ্ঠানের ‘সমঝোতায়’ পূর্বেকার ইজারার অর্ধেক মূল্যে টেন্ডার দেয়। তা অনুমোদনের জন্য বিভিন্ন কৌশলের আশ্রয় নেওয়া হয়। কিন্তু টেন্ডারে অংশ নিতে পারেনি এমন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের তৎপরতায় ১২ নভেম্বর পুনরায় কোটেশন আহ্বান করে সিলেট সড়ক বিভাগ। তাতেও সিন্ডিকেটদের সুবিধাবাদী চক্র নানা রকম চাপ সৃষ্টি ও হুমকি-ধামকি দিয়ে অন্যান্য দরপত্র ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে সরিয়ে দেয়। কোনোভাবেই ৩০টি দরপত্র ক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান টেন্ডার জমা দিতে পারেনি। টেন্ডার জমাদানকারী দুইটি প্রতিষ্ঠান হচ্ছে, মাহি এন্টারপ্রাইজ ও হক এন্টারপ্রাইজ। এরমধ্যে মাহি এন্টারপ্রাইজ টেক্স ভ্যাট ছাড়া ১০ কোটি ৬ লাখ ৩৭ হাজার ৫০শ টাকা ও হক এন্টারপ্রাইজ ১০ কোটি ৩ লাখ ৩৬ হাজার ৫৫০ টাকা মূল্যে টেন্ডার জমা দেয়। সর্বোচ্চ দরপত্রদাতা প্রতিষ্ঠান মাহি এন্টারপ্রাইজ নিয়মানুসারে ইজারা পায়। গুরুত্বপূর্ণ এই সেতুটি কম মূল্যে ইজারা প্রদান করায় সরকারের প্রায় ১০ কোটি টাকার রাজস্ব হারিয়েছে। সূত্রঃ বাংলানিউজ