- জুন ১২, ২০২৫
- জাতীয়
- 2

নিউজ ডেস্কঃ সরকারিভাবে ২০২৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশে শিশুশ্রম শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার কথা ছিল। অন্যদিকে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ২০৩০ সালের মধ্যে সব রকম শিশুশ্রম বন্ধ করার তাগিদ আছে বিশ্বদরবার থেকে। কিন্তু দেশে শিশুশ্রম কমার পরিবর্তে তা বেড়েই চলেছে। জাতীয় শ্রম জরিপ ২০২২ সে কথাই বলছে। এই জরিপ অনুযায়ী দেশে ৩৫ লাখ ৩৬ হাজার ৯২৭ শিশু বিভিন্ন ধরনের শ্রমে নিয়োজিত আছে, যা ২০১৩ সালে ছিল ৩৪ লাখ ৫০ হাজার ৩৬৯। অর্থাৎ ১০ বছরে দেশে শিশু শ্রমিক বেড়েছে ৮৬ হাজার ৫৫৮ জন। শিশু অধিকার কর্মীরা বলছেন, যে বয়সে শিশুদের সৃজনশীল কাজে ব্যস্ত থাকার কথা, সে সময় আর্থিক অনটনে বাংলাদেশের বড় সংখ্যক শিশুই বিভিন্নভাবে শ্রমে নিয়োজিত হচ্ছে। এসব শিশুকে শ্রম থেকে সরাতে প্রয়োজন আর্থিক সহায়তা ও সুশিক্ষা নিশ্চিত করা।
এ অবস্থায় আজ বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দেশে পালিত হচ্ছে ‘বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস’। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য হলো- ‘স্বপ্নের ডানায় ভর করি, শিশুশ্রমের শৃঙ্খল ছিঁড়ি- এগিয়ে চলি দৃপ্ত পায়ে, আশার আগুন বুকে জ্বালি’। তবে ঈদের ছুটি পড়ায় এবার দিবসটি সরকারিভাবে পালন করা হবে ১৯ জুন।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) পরিচালিত ‘সেক্টরভিত্তিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত শিশুশ্রম জরিপ ২০২৩’-এর প্রতিবেদন আরও বলছে, দেশে শিশুর সংখ্যা প্রায় চার কোটি। এর মধ্যে ২০ লাখ ৯০ হাজার শিশু গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করে। তাদের মধ্যে আবার ২০ লাখ ১০ হাজার শিশু শ্রমিক কোনো পারিশ্রমিক পায় না। যারা পারিশ্রমিক পায়, তাদের গড় আয় মাসে ৬ হাজার ৬৭৫ টাকা। এ ছাড়া শিশু শ্রমিকদের মধ্যে ১০ লাখ ৭০ হাজার ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে।
অন্যদিকে বিবিএসের ওই প্রতিবেদনে শিশুশ্রমের আরও গভীর চিত্র উঠে এসেছে। এই জরিপের তথ্য অনুযায়ী, ঝুঁকিপূর্ণ পাঁচটি খাতের ৪০ হাজার ৫২৫টি কারখানায় সব মিলিয়ে ৩৮ হাজার ৮ জন শিশু কাজ করে। তাদের প্রায় ৯৮ শতাংশ ছেলে, বাকিরা মেয়ে। এর মধ্যে মোটর যানবাহনের রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতে (অটোমোবাইল ওয়ার্কশপ) ২৪ হাজার ৯২৩ জন, পাদুকা উৎপাদনে ৫ হাজার ২৮১ জন, ওয়েল্ডিংয়ের কাজ বা গ্যাস বার্নার মেরামতের ৪ হাজার ৯৯ জন এবং টেইলারিং ও পোশাক খাতে ২ হাজার ৮০৫ শিশু কাজ করে। আর শুঁটকি উৎপাদনে কাজ করে ৮৯৮ জন।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও ইউনিসেফ পরিচালিত ‘সার্ভে অন স্ট্রিট চিলড্রেন ২০২২’ শীর্ষক জরিপ অনুযায়ী, শ্রমে নিয়োজিত শিশুদের মধ্যে ৩১ শতাংশ কাজ করতে গিয়ে বিভিন্নভাবে আহত হয়েছে। আহত শিশুদের মধ্যে ৬৭ শতাংশের ক্ষেত্রে আঘাত ও কাটাছেঁড়ার ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়া ভারী বস্তু বহনের ফলে ঘাড়, পিঠ ও কোমরে ব্যথা, হাড় ভাঙা, দগ্ধ হওয়া এবং মারধরের শিকার হওয়ার ঘটনাও সামনে এসেছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) তথ্যমতে, ২০২৩ সালে কর্মস্থলে সহিংসতার কারণে ২০ জন শিশু শ্রমিক প্রাণ হারিয়েছে।
অথচ বাংলাদেশ শ্রম (সংশোধন) আইন, ২০১৮-এর খসড়ায় শিশুশ্রম সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। নতুন আইনে যদি কেউ শিশু শ্রমিক নিয়োগ করে, তাহলে তার বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ ৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রাখা হয়। সংশোধিত আইনে ১৪ থেকে ১৮ বছর বয়সী কিশোরদের হালকা কাজে নিয়োগ দেওয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে, যেখানে আগে ১২ বছর বয়সী শিশুরাও হালকা কাজে নিয়োজিত হওয়ার অনুমতি পেত।
জাতীয় শিশুশ্রম নিরসন নীতি ২০১০ অনুযায়ী, শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ কোনো কাজে নিয়োগ দেওয়া সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। ১২ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশুরা যদি সপ্তাহে সর্বোচ্চ ৪২ ঘণ্টা পর্যন্ত হালকা বা ঝুঁকিমুক্ত কাজ করে, তাহলে সেটিকে অনুমোদনযোগ্য শ্রম হিসেবে গণ্য করা হয়। তবে ৫ থেকে ১১ বছর বয়সী কোনো শিশু যদি ঝুঁকিমুক্ত কাজেও নিয়োজিত হয়, সেটিকে শিশুশ্রম হিসেবে বিবেচনা করা হবে। এ ছাড়া ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী কোনো শিশু যদি সপ্তাহে ৪২ ঘণ্টার বেশি কাজ করে, তা ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম হিসেবে গণ্য হবে।
বিবিএস প্রকাশিত জাতীয় শিশুশ্রম জরিপ বিশ্লেষণে দেখা যায়, দেশে ২০২৩ সাল পর্যন্ত যে ৩৫ লাখ ৩৬ হাজার শিশু শ্রমে নিয়োজিত তার মধ্যে সরাসরি শ্রমিক আছে ১৭ লাখ ৭৬ হাজার।
দেশে শিশুশ্রম নিরসনে ‘জাতীয় শিশুশ্রম নিরসন নীতি-২০১০’ প্রণয়ন ছাড়াও শিশুদের উন্নয়ন ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে ‘জাতীয় শিশু নীতি-২০১১’, ‘শিশু আইন-২০১৩’, ‘বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন-২০১৭’ এবং গৃহকর্মে নিয়োজিত শিশুদের অধিকার ও সুরক্ষায় ‘গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতি-২০১৫’ প্রণয়ন করা হয়েছে। কিন্তু শিশু অধিকার কর্মীরা বলছেন, কেবল নীতিতেই আবদ্ধ থাকায় অনেক ক্ষেত্রেই শিশুদের অধিকার রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না। তারা বলছেন, নীতিগুলোকে দ্রুত আইনে পরিবর্তন করা প্রয়োজন। প্রয়োজন কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা। তারা আরও বলছেন, শিশুশ্রম রোধে সরকারি অনেক প্রকল্প থাকলেও পর্যাপ্ত জনবলের অভাব এবং শিশুশ্রম নিরসনে কঠোর আইন না থাকায় দেশে যেমন কমছে না শিশুশ্রম, তেমনি উঠে আসছে না এর সঠিক চিত্র।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্রেকিং দ্য সাইলেন্সের ডিরেক্টর (প্রোগ্রাম অ্যান্ড প্ল্যানিং) জাহিদুল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, ‘শিশুদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আমরা দেখেছি শিশুদের শ্রমে যাওয়ার মুল কারণ হচ্ছে পারিবারিক অসচ্ছলতা। অল্প বয়সে যখন তাদের কাঁধে পরিবারের দায়িত্ব এসে পড়ে, তখনই তারা বিভিন্ন কাজে জড়িয়ে যায়। এর মধ্যে যেসব কাজ ঝুঁকিপূর্ণ, সেগুলোতে মজুরি বেশি থাকায় তারা ওই সব কাজে বেশি ঝোঁকে।’
সেভ দ্য চিলড্রেন বাংলাদেশের শিশু সুরক্ষা ও শিশু অধিকার পরিচালনা সেক্টরের পরিচালক আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘সরকারি-বেসরকারিভাবে শিশুশ্রম বন্ধে অনেক প্রকল্প আছে। এর মধ্যে সরকারি প্রকল্পের সংখ্যা অনেক। কিন্তু পর্যাপ্ত জনবল না থাকায় অর্থ বরাদ্দ থাকলেও প্রকল্পগুলোর সুফল পাচ্ছে না শিশুরা। কারণ শিশুশ্রম কমাতে হলে সেই সব শিশুকে খুঁজে তাদের শ্রমে আসার প্রকৃত কারণ খুঁজে বের করা প্রয়োজন। যদি তার আর্থিক সহায়তা লাগে, তাহলে তা দিয়ে তাদের সেই শ্রম থেকে সরানো প্রয়োজন। রেগুলার এটির মনিটরিং প্রয়োজন। এ ছাড়া তার পরিবারের অন্য সদস্যকে ওই শিশুর বিকল্প হিসেবে উপার্জনের ব্যবস্থা করে দেওয়া যেতে পারে। আর শিশুটি যদি ১৪ বছরের বেশি বয়সী হয়, তাহলে তাকে কোনো ঝুঁকিবিহীন কাজের প্রশিক্ষণ দিয়ে উপার্জনের ব্যবস্থা করে দেওয়া যেতে পারে। আমরা বেসরকারিভাবে এটি করে থাকি। কিন্তু সরকারি প্রকল্পে যেহেতু বরাদ্দ বেশি তাই তারাও এই বিষয়গুলো আমলে নিতে পারেন। এতে পরিবারগুলো সচেতন হবে এবং শিশুশ্রম কমে আসবে।’