- নভেম্বর ১৬, ২০২৫
- জাতীয়
- 5
নিউজ ডেস্কঃ রাত পোহালেই শেখ হাসিনার মামলার রায়। মানবতাবিরোধী অপরাধে প্রথমবারের মতো দেশের কোনো সাবেক প্রধানমন্ত্রী সাজার মুখোমুখি হতে যাচ্ছেন। আর এ রায় ঘিরে দেশ-বিদেশের মানুষের নজর এখন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দিকে। জুলাই গণহত্যার দায়ে কী সাজা পাবেন একসময়ের প্রতাপশালী প্রধানমন্ত্রী-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী; এমন কানাঘুষা চলছে সর্বত্র। অপেক্ষার প্রহর যেন শেষ হতে চলেছে জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে জীবনপ্রদীপ নিভে যাওয়া হাজারো শহীদ আর আহত পরিবারের।
শেখ হাসিনার রায়কে কেন্দ্র করে ট্রাইব্যুনাল ও সুপ্রিম কোর্ট এলাকায় জোরদার করা হয়েছে নিরাপত্তাব্যবস্থা। পুলিশ-বিজিবির পাশাপাশি নিয়োজিত রয়েছে সেনাবাহিনী। তৎপর গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরাও। এরই মধ্যে নিরাপত্তার স্বার্থে রোববার (১৬ নভেম্বর) সন্ধ্যার পর থেকে দোয়েল চত্বর হয়ে শিক্ষা ভবনমুখী সড়কে যান চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। একইসঙ্গে সীমিত করা হয়েছে পথচারীদের চলাচল। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বেঞ্চ বসার সময়ও নির্ধারণ হয়েছে। সোমবার (১৭ নভেম্বর) বেলা ১১টায় কার্যক্রম শুরু হবে বলে জানিয়েছে রেজিস্ট্রার কার্যালয়।
মানবতাবিরোধী অপরাধের এ মামলায় শেখ হাসিনা ছাড়াও আসামি সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুন। যদিও রাজসাক্ষী হয়ে নিজের একসময়ের দুই কর্তার বিরুদ্ধে হাঁটে হাঁড়ি ভাঙেন সাবেক আইজিপি মামুন। অজানা সব তথ্যের ঝাঁপি খুলে দেওয়ায় তার শাস্তির সিদ্ধান্ত এখন ট্রাইব্যুনালের কাছে। তবে বাকি দুজনেরই সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড চেয়েছে প্রসিকিউশন। আর মামুনের খালাস চেয়েছেন তার আইনজীবী যায়েদ বিন আমজাদ। পিছিয়ে থাকেননি হাসিনা-কামালের পক্ষে রাষ্ট্রের খরচে নিয়োগ করা আইনজীবী মো. আমির হোসেনও। ন্যায়বিচার হলে সব অপরাধের প্রাণভোমরা আর কমান্ডার খ্যাত সাবেক প্রধানমন্ত্রী-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও খালাস পাবেন বলে তার দৃঢ় বিশ্বাস।
জানা গেছে, গোটা জাতিকে শেখ হাসিনার রায় কার্য সরাসরি দেখানো হবে। ঢাকার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে বসানো হবে বড় পর্দা। বিচারকাজকে স্বচ্ছ রাখতে করা হচ্ছে এমন আয়োজন। এ ছাড়া রায় শুনতে সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছে প্রসিকিউশন। ন্যায়বিচারের স্বার্থে ট্রাইব্যুনাল যে আদেশ দেবেন তা মেনে নেওয়া হবে বলেও জানিয়েছেন তারা।
বিটিভিতে শেখ হাসিনার মামলার রায়ের কার্যক্রম সরাসরি সম্প্রচার করা হবে জানিয়ে প্রসিকিউটর গাজী এমএইচ তামিম বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনালে এটিই সর্বপ্রথম রায় হবে। অনুমতি সাপেক্ষে ট্রাইব্যুনালে পড়া রায়ের অংশটুকু বাংলাদেশ টেলিভিশনের মাধ্যমে সরাসরি সম্প্রচার করতে পারবে দেশের সব গণমাধ্যম।
সুনির্দিষ্ট পাঁচটি অভিযোগ আনা হয় হাসিনা-কামাল ও মামুনের বিরুদ্ধে। এর মধ্যে প্রথমটি হলো উসকানি। গত বছরের ১৪ জুলাই গণভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনরত ছাত্র-জনতাকে রাজাকার বলে সম্বোধন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই রাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তখনকার ভিসি মাকসুদ কামালের সঙ্গে ফোনে আন্দোলনকারীদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়নের আদেশ দেন তিনি। ১৮ জুলাই ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন সাবেক এই সরকারপ্রধান। ফোনে আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার ওপর মারণাস্ত্র ব্যবহারের পাশাপাশি হেলিকপ্টারে গুলির নির্দেশ দেওয়া হয়। একইসঙ্গে ড্রোনের মাধ্যমে ছাত্র-জনতার অবস্থান নির্ণয়ের নির্দেশ দেন হাসিনা।
তার এমন প্রত্যক্ষ নির্দেশনার মাধ্যমে দেশজুড়ে প্রাণ হারিয়েছেন ১৪০০ ছাত্র-জনতা। আহত হয়েছেন কয়েক হাজার আন্দোলনকারী। তৃতীয় অভিযোগটি হলো রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ হত্যা। আর চতুর্থ-পঞ্চম অভিযোগটি যথাক্রমে চানখারপুলে ছয়জনকে হত্যা ও আশুলিয়ায় ছয়জনকে হত্যার পর লাশ পুড়িয়ে দেওয়া। এই পাঁচটি অভিযোগই সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে পেরেছে বলে দাবি প্রসিকিউশনের। এর পরিপ্রেক্ষিতে আসামিদের সর্বোচ্চ সাজা চেয়ে সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে ভুক্তভোগী শহীদ-আহত পরিবারের কাছে হস্তান্তরের আবেদন করা হয় ট্রাইব্যুনালে।
প্রসিকিউশনের তথ্যমতে, এ মামলায় মোট ২৮ কার্যদিবসে ৫৪ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য-জেরা শেষ হয়। আর ৯ কার্যদিবসে চলে প্রসিকিউশন-স্টেট ডিফেন্সের যুক্তিতর্ক পাল্টা যুক্তিখণ্ডন। ২৩ অক্টোবর রাষ্ট্রের প্রধান আইনকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামানের সমাপনী বক্তব্য এবং চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম ও রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেনের যুক্তিখণ্ডন শেষে রায়ের তারিখ নির্ধারণে সময় দেন ট্রাইব্যুনাল। ১৩ নভেম্বর সেই দিনক্ষণও ঠিক করা হয়। অর্থাৎ শেখ হাসিনার এ মামলার রায় ঘোষণার জন্য ১৭ নভেম্বর ধার্য করেন ট্রাইব্যুনাল-১।
তথ্য বলছে, মোট ৮৪ জনকে সাক্ষী করেছে প্রসিকিউশন। তবে রাজসাক্ষীসহ সাক্ষ্য দিয়েছেন ৫৪ জন। এর মধ্যে চাক্ষুষ সাক্ষী সাতজন, আহত ভুক্তভোগী দুজন, ভুক্তভোগীর পরিবারের আটজন, আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী সাতজন, আহতদের চিকিৎসক সাক্ষী তিনজন এবং জব্দ তালিকার সাক্ষী রয়েছেন ১৪ জন। সাংবাদিক হিসেবে সাক্ষ্য দিয়েছেন একজন। ময়নাতদন্তকারী একজন, ঘটনার সমর্থন সাক্ষী দুজন, রাজসাক্ষী একজন, বিশেষ তদন্তকারী একজন ও মূল তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে একজনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ম্যাজিস্ট্রেট, বিশেষজ্ঞ, ওয়ারল্যাস বার্তার সাক্ষী হিসেবে একজন করে; ফরেনসিক, ঘটনার পটভূমির সাক্ষী হিসেবে দুজন করে জবানবন্দি দিয়েছেন ট্রাইব্যুনালে।
ট্রাইব্যুনাল সূত্র জানায়, শেখ হাসিনার পতনের পর গত বছরের ১৪ আগস্ট আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে একটি অভিযোগ দায়ের হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে দুই মাস পর অর্থাৎ ১৪ অক্টোবর তদন্তকাজ শুরু করেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। তদন্তে জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে দেশজুড়ে সংঘটিত হত্যাকাণ্ড, লাশ পুড়িয়ে ফেলাসহ সব মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রধান ‘মাস্টারমাইন্ড’ বা ‘সুপিরিয়র কমান্ডার’ হিসেবে শেখ হাসিনার নাম উঠে আসে। এরই ধারাবাহিকতায় জুলাই-আগস্টে গণহত্যার হুকুমদাতা হিসেবে শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে চলতি বছরের ১২ মে প্রতিবেদন জমা দেয় তদন্ত সংস্থা। এরপর ট্রাইব্যুনাল-১ এ আনুষ্ঠানিক অভিযোগ জমা দেয় প্রসিকিউশন।
দুই ধাপে শুনানি শেষে তাদের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেওয়া হয়। ১০ জুলাই এ আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেল। এ মামলায় শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের পাঁচটি অভিযোগ আনে প্রসিকিউশন। আনুষ্ঠানিক অভিযোগ মোট আট হাজার ৭৪৭ পৃষ্ঠার। এর মধ্যে তথ্যসূত্র দুই হাজার ১৮ পৃষ্ঠার, জব্দ তালিকা ও দালিলিক প্রমাণাদি চার হাজার পাঁচ পৃষ্ঠার ও শহীদদের তালিকার বিবরণ দুই হাজার ৭২৪ পৃষ্ঠার।
বিচার শুরুর আদেশের পরই শুরু হয় আনুষ্ঠানিকতা। চলতি বছরের ৩ আগস্ট প্রথম সাক্ষী হিসেবে ট্রাইব্যুনালে জুলাই-আগস্টের বীভৎসতার চিত্র তুলে ধরেন খোকন চন্দ্র বর্মণ। বাঁ চোখ নষ্ট আর নাক-মুখ না থাকলেও দৃঢ় মনে সাক্ষ্য দেন ২৩ বছরের এই তরুণ। গত বছরের ৫ আগস্ট পুলিশের ছোড়া গুলিতে তার পুরো চেহারা বিকৃত হয়ে যায়। তিনিই হন জুলাই গণহত্যার মামলার প্রথম সাক্ষী। ৮ অক্টোবর মূল তদন্ত কর্মকর্তা মো. আলমগীরের জেরার মাধ্যমে শেষ হয় মামলার সাক্ষ্যগ্রহণের ধাপ। তিনি ৫৪তম সাক্ষী ছিলেন।
৪৬ নম্বর তথা তারকা সাক্ষী হিসেবে আওয়ামী দুঃশাসনের পটভূমি তুলে ধরেন আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান। একইসঙ্গে জুলাই-আগস্টে গণহত্যাসহ গত ১৬ বছরের গুম-খুনেরও বর্ণনা দেন তিনি। মাহমুদুর রহমানের পরই জবানবন্দি দেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। তিনিও বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরেন। লেখক-গবেষক বদরুদ্দীন উমরের মৃত্যুর আগে তদন্ত কর্মকর্তার কাছে দেওয়া জবানবন্দিও এ মামলায় সাক্ষ্য হিসেবে নেওয়া হয়। এ ছাড়া ৩৬ নম্বর সাক্ষী হিসেবে আওয়ামী লীগ সরকারের টানা ১৬ বছরের শাসনামলের অজানা সব তথ্য ট্রাইব্যুনালের সামনে আনেন রাজসাক্ষী চৌধুরী মামুন, চেয়েছেন ক্ষমাও।
এ মামলায় দালিলিক হিসেবে ৯০টি তথ্যচিত্র ও ৩৫টি বস্তুগত প্রমাণ জমা দেয় প্রসিকিউশন। এর মধ্যে তৎকালীন সরকারের সিদ্ধান্ত, গুলির নির্দেশনা, অডিও-ভিডিওসহ জব্দ করা বিভিন্ন নথিপত্র রয়েছে। মামলার বিশেষ তদন্ত কর্মকর্তা ও প্রসিকিউটর তানভীর হাসান জোহার সাক্ষ্যের দিন চারটি ফোনালাপের অডিও রেকর্ড বাজিয়ে শোনানো হয় ট্রাইব্যুনালে; যা যুক্তিতর্কে শক্তভাবে উপস্থাপন করা হয়। ফোনালাপের একটি শেখ হাসিনা-শেখ ফজলে নূর তাপসের, একটি হাসিনার সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি মাকসুদ কামালের এবং দুটি হাসিনার সঙ্গে জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনুর।
রায়ের তারিখ ধার্য হওয়ার দিন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেছিলেন, আমরা অঙ্গীকার করেছিলাম যারাই বাংলাদেশে যত শক্তিশালীই হোক না কেন, যদি কেউ মানবতাবিরোধী অপরাধ করে তাদের সঠিক পন্থায় বিচারের মুখোমুখি করা হবে। আইন অনুযায়ী তাদের যে প্রাপ্য সেটা বুঝিয়ে দেওয়া হবে। সেই প্রক্রিয়ায় আমরা দীর্ঘ যাত্রা শেষ করেছি। এখন চূড়ান্ত পর্বে উপনীত হয়েছি। আশা করছি সুবিবেচনায় নিজের প্রজ্ঞা প্রয়োগ করবেন আদালত। বিচারের জন্য জাতির যে আকাঙ্ক্ষা তৃষ্ণা, সেটার সুবিচার করবেন। এ ছাড়া একটি সঠিক রায়ের মাধ্যমে বাংলাদেশে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের একটি ইতি ঘটাবেন। একইসঙ্গে ভবিষ্যতের জন্য এ রায়টি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে, তেমনটি আমরা প্রত্যাশা করছি।
