- ডিসেম্বর ৮, ২০২৫
- লিড নিউস
- 3
নিউজ ডেস্কঃ নভেম্বর মাস। সিলেট থেকে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের শিলং যাত্রাপথের ডাউকির ঝুলন্ত সেতুর মুখে আটকা পড়ল গাড়ি। ঝুলন্ত সেতুর এপার-ওপারে দীর্ঘ যানজট। এপারের যানবাহন ওপারে যেতেই গাড়ির দীর্ঘ লাইন ডাউকি বাজার পর্যন্ত গড়ায়। যানজটের কারণ, ঝুলন্ত সেতুর এক প্রান্তে ভূমিধস। পান-দোকানি এক খাসিয়া নারীর সঙ্গে কথা হয়। আধো বাংলা-হিন্দিতে চলছিল কথাবার্তা। শেষ কথাটিই কানে বাজল। ‘ডাউকি জিন্দা হ্যায়!’
দেশে সাম্প্রতিক ভয়াবহ ভূমিকম্পের উৎস সন্ধানে বিভিন্ন ফল্ট চিহ্নিত হচ্ছে। সর্বশেষ একটি ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল দেখানো হচ্ছিল ডাউকি। ভূতাত্ত্বিক অবস্থানগত কারণে পুরো বাংলাদেশই ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা। যেসব মহানগর ভূমিকম্পের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে, রাজধানী ঢাকা ও বন্দরনগরী চট্টগ্রামের পর সিলেট তার মধ্যে অন্যতম। সিলেটের জন্য শঙ্কা হচ্ছে মেঘালয়ের ডাউকি। ১৮৯৭ সালে ‘গ্রেট আসাম ভূমিকম্প’ কিংবা ১৯১৮ সালের ভূমিকম্প এ অঞ্চলের ভূ-প্রকৃতিকে আমূল পাল্টে দিয়েছিল।
জানা গেছে, ডাউকি ফল্ট প্রায় ৩০০ কিলোমিটার লম্বা। ভূতাত্ত্বিক গবেষণায় দেখা যায়, এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্লেট বাউন্ডারি এরিয়ায় অবস্থিত। যেখানে ইন্ডিয়ান, ইউরেশিয়ান ও বার্মা প্লেটের সংঘর্ষ অব্যাহত রয়েছে। মেঘালয়ের শিলং মালভূমির দক্ষিণ প্রান্ত বরাবর, সোজা পূর্ব-পশ্চিমে ৩০০ কিলোমিটার। অর্থাৎ সিলেট অঞ্চল এই ফল্টের প্রায় ফ্রন্টলাইনে। ইন্ডিয়ান প্লেট একদিকে ধাক্কা দিচ্ছে, ইউরেশিয়ান আর বার্মা প্লেট অন্যদিকে দাঁড়িয়ে আছে। এর মধ্যে চলছে চাপাচাপি। চাপ বেশি হলেই ফল্টলাইনে স্লিপ হয় আর তা থেকে হয় ভূমিকম্প। মাত্রাভেদে ক্ষয়ক্ষতি হয়। ১৮৯৭ সালে ৮ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল।
সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, ডাউকির সেই ফল্ট বা চ্যুতি বড় ভয়ংকর। পাহাড়ের গা যেন এখনো নড়ছে ও ধসছে। গত বর্ষকালে ঝুলন্ত সেতুর পাহাড়ধস প্রত্যক্ষ করেছেন স্থানীয়রা। ডাউকি বাজার থেকে ঝুলন্ত সেতু পেরিয়ে এপার-ওপার তাকালেই ভূমিকম্পের চিহ্নের সেই ভূমিরূপ চোখ থেকে মনে পর্যন্ত আতঙ্ক ছড়ায়। ফল্ট বা চ্যুতিতে সৃষ্ট ডাউকি নামের যে নদীটি বাংলাদেশের জাফলং হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে, সেটি পিয়াইন নদে গিয়ে মিলিত হয়েছে। ডাউকির পাহাড়ভূমি থেকে পিয়াইন নদের মোহনাও ভূমিকম্পের ভূমিরূপ পরিবর্তনের চিহ্ন এখনো বহন করছে। ডাউকি ফল্ট থেকে কি আরও একটি ভূমিকম্প অপেক্ষা করছে?
ডাউকি দেখে এ রকম প্রশ্ন মনে উঁকি দেওয়া স্বাভাবিক। সেখানকার বাসিন্দা থেকে শুরু করে পর্যবেক্ষণকারী সবার ধারণা, ডাউকি ফল্ট থেকে যেহেতু ভূমিকম্পের সূত্রপাত, তাহলে আরও একটি বড় ভূমিকম্প অপেক্ষমাণ। সিলেট ও সুনামগঞ্জে সর্বশেষ ভূকম্পন অনুভূত হয়েছে গত শুক্রবার। মৃদু ভূমিকম্পের উৎস সন্ধানে ডাউকি নামটি প্রকাশ হওয়ায় বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডাউকি হচ্ছে সবচেয়ে অ্যাকটিভ ফল্ট।
বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে প্রান্তিক এক খাসিয়া নারীর বলা ‘ডাউকি জিন্দা হ্যায়’ কথা মিলে যায়। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ারুল ইসলাম বলেছেন, ‘ডাউকি ফল্টের কারণে ভূমিকম্পের ঝুঁকির কথা যদি বলেন,তাহলে বাংলাদেশ অনেকটা রিস্ক জোনে আছে। কারণ ডাউকি হলো সবচেয়ে অ্যাকটিভ ফল্ট। আর্থকোয়েক ইনটেনসিটি অথবা ফ্রিকোয়েনসিটি অব আর্থকোয়েক অথবা লেভেল অব আর্থকোয়েকের কথা চিন্তা করলে সব দিক থেকেই ডাউকি ফল্ট এগিয়ে আছে। এখানে ভূমিকম্পের শঙ্কা সবচেয়ে বেশি। রিস্ক বা ক্ষয়ক্ষতির দিক থেকে বলি, যেটাকে গবেষণার ভাষায় বলা হয় আর্থকোয়েক ভালনারেবিলিটি, তাহলে সিলেটের তুলনায় ঢাকা বা গাজীপুর অঞ্চল মারাত্মক ঝুঁকিতে আছে।’
সিলেটের কথা তুলে ধরে ড. আনোয়ারুল আরও বলেন, ‘ডাউকি ফল্টে ভূমিকম্প হলে সিলেটে বিপর্যয়ের আশঙ্কা ঢাকার তুলনায় অনেক কম। কারণ ঢাকায় যে ধরনের ইনফ্রাস্ট্রাকচার রয়েছে বা গাজীপুরের যে ঘনবসতি, তাতে ছোট মাত্রার ভূমিকম্প হলেও এসব এলাকায় মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে। আমাদের গবেষণা বলছে, ঝুঁকির দিক থেকে গাজীপুর-ঢাকা অঞ্চল সবার ওপরে।’
এদিকে ভূমিকম্পের ক্ষতি কমাতে তৎপর সিলেটের জেলা প্রশাসনসহ সিলেট সিটি করপোরেশন। সম্প্রতি সিলেট নগরীতে ২৩টি ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা প্রকাশ করেছে সিলেট সিটি করপোরেশন (সিসিক)। পাশাপাশি চিহ্নিত ভবন অপসারণে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ২৪ নভেম্বর সিটি করপোরেশনের আয়োজনে নগর ভবনের সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত ভূমিকম্পের পূর্বপ্রস্তুতি ও পরবর্তী করণীয় নির্ধারণে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির জরুরি সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সিটি করপোরেশনের প্রশাসকের দায়িত্বে থাকা সিলেট বিভাগীয় কমিশনার খান মো. রেজা-উন-নবীর সভাপতিত্বে সভায় জেলা প্রশাসক মো. সারওয়ার আলম, সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ রেজাই রাফিন সরকারসহ শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) সিভিল অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষকরা উপস্থিত ছিলেন।
এর আগে ২০১৯ ও ২০২১ সালে কয়েক দফা মৃদু ভূমিকম্পকে বলা হয়েছিল সিরিজ ভূমিকম্প। বড় ভূমিকম্পের বার্তা হিসেবে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে সিলেট নগরীর ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকাও তৈরি করা হয়েছিল। সেই তালিকা হালনাগাদ করে নতুন করে ঝুঁকিপূর্ণ তালিকা তৈরি করা হয়েছে সাম্প্রতিক সভায়। সিসিকের তালিকাভুক্ত ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলোর শীর্ষে ছিল কয়েকটি সরকারি দপ্তর। এগুলো হচ্ছে কালেক্টরেট ভবন-৩, সমবায় ব্যাংক ভবন মার্কেট, মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তার সাবেক কার্যালয়। সরকারি ভবন ছাড়াও বিভিন্ন বিপণিবিতানও রয়েছে। ২৩টি ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা করে এগুলো অপসারণ এক সপ্তাহের মধ্যে শুরু করার কথা ছিল।
সপ্তাহ গড়ালেও এ নিয়ে কোনো পদক্ষেপ নেই। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিসিকের জনসংযোগ দপ্তর থেকে বলা হয়, দুর্যোগ ও ব্যবস্থাপনা কমিটির পরবর্তী সভায় এ ব্যাপারে করণীয় নির্ধারণ করে পদক্ষেপ নেওয়া হবে। সূত্র: খবরের কাগজ
