• ডিসেম্বর ২৬, ২০২৫
  • জাতীয়
  • 2
তারেক রহমানের আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তায় বাড়ছে নিরাপত্তা ঝুঁকি

নিউজ ডেস্কঃ দীর্ঘ ১৭ বছরের নির্বাসিত জীবনের অবসান ঘটিয়ে ২৫ ডিসেম্বর বাংলাদেশের মাটিতে পা রেখেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তার এই স্বদেশ প্রত্যাবর্তন কেবল একজন রাজনৈতিক নেতার ফিরে আসা নয়, বরং দেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এই প্রত্যাবর্তনকে দেখা হচ্ছে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা হিসেবে।

মা ও মাটির টানে এবং দেশকে গণতন্ত্রের পথে উত্তরণের অঙ্গীকার নিয়ে তার এই ফেরা রাজধানী ঢাকাকে পরিণত করেছিল এক জনসমুদ্রে। তবে এই বিপুল জনসমাগম এবং বীরোচিত সংবর্ধনার আড়ালে উঁকি দিচ্ছে একটি বড় প্রশ্ন-আগামীর নির্বাচনী প্রচারণায় তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা কতটা চ্যালেঞ্জিং হবে? রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, তারেক রহমানের জীবনের ঝুঁকি এবং জনতাকে সামলানোর কঠিন সমীকরণটি এখন থেকেই গভীরভাবে ভাবনার দাবি রাখে।

আগামীর নির্বাচনী লড়াইয়ে যখন তাকে দেশের আনাচে-কানাচে যেতে হবে, তখন এই বিশাল জনস্রোত কি তার জন্য আশীর্বাদ হবে, নাকি বড় কোনো বিপদের কারণ? রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, তারেক রহমানের সামনে এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো নিজের আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা এবং প্রাণের ঝুঁকি-এই দুয়ের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা।

২৫ ডিসেম্বর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তারেক রহমান অবতরণ করার পর থেকেই শুরু হয় এক নজিরবিহীন উন্মাদনা। বিমানবন্দর থেকে এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মা বেগম খালেদা জিয়াকে দেখতে যাওয়ার পথে পূর্বাচল সংলগ্ন ‘জুলাই ৩৬ এক্সপ্রেসওয়ে’-তে আয়োজিত এক সংক্ষিপ্ত সংবর্ধনায় অংশ নেন তিনি। সেখানে সমবেত হওয়া লাখো মানুষের উদ্দেশ্যে তিনি সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন।

বিএনপির দাবি, তারেক রহমানকে এক নজর দেখতে এবং বরণ করে নিতে সেদিন সারা দেশ থেকে আসা প্রায় ৫০ লাখের বেশি মানুষ ঢাকার রাজপথে অবস্থান নিয়েছিল।
এই বিশাল জনস্রোত সামাল দেওয়া ছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য এক অগ্নিপরীক্ষা। বিমানবন্দর থেকে গুলশান পর্যন্ত পুরোটা রাস্তা ছিল লোকে লোকারণ্য। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, তারেক রহমানের প্রতি মানুষের এই স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ মূলত দীর্ঘ দেড় দশকের রাজনৈতিক রুদ্ধশ্বাস পরিস্থিতির বহিঃপ্রকাশ।

কিন্তু এই বিপুল জনসমাগম যখন কোনো নির্দিষ্ট প্রটোকল মানে না, তখন নিরাপত্তা ব্যবস্থা বিঘ্নিত হওয়ার প্রবল আশঙ্কা থাকে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনো কোনো রাজনৈতিক নেতার জন্য এমন নিরাপত্তা ব্যবস্থা দেখা যায়নি। বিমানবন্দর থেকে পূর্বাচলের জুলাই ৩৬ এক্সপ্রেসওয়ে, এভারকেয়ার হাসপাতাল থেকে শুরু করে গুলশান অ্যাভিনিউয়ের বাসভবন পর্যন্ত প্রতিটি ইঞ্চি জায়গা ছিল নিরাপত্তা বাহিনীর বিশেষ নজরদারিতে। নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিল সেনাবাহিনী, র‍্যাব, বিজিবি, ডগ স্কোয়াড, ডিএমপি, এপিবিএন এবং আনসারের সমন্বিত একটি শক্তিশালী দল। এছাড়া ছিল তার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বাহিনী ‘চেয়ারপারসনস সিকিউরিটি ফোর্স’ (সিএসএফ)।

ডিএমপি সূত্রে জানা যায়, কেবল পুলিশেরই ৪ হাজার ৬৪৯ জন সদস্য সরাসরি এই ডিউটিতে নিয়োজিত ছিলেন। বিশেষ নজরদারিতে ছিল মিরপুর সেনানিবাসের এয়ার ডিফেন্স (এডি) আর্টিলারি ইউনিট এবং ৪৬ ব্রিগেডের সেনাসদস্যরা। এক্সপ্রেসওয়ের সুউচ্চ ভবনগুলোতে অবস্থান নিয়েছিলেন স্নাইপার ও বিশেষায়িত বাহিনীর সদস্যরা। নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, রাষ্ট্রীয়ভাবে তারেক রহমানকে যে পর্যায়ের নিরাপত্তা দেওয়া হয়েছে, তা ইঙ্গিত দেয় যে তার জীবনের ওপর ঝুঁকির মাত্রা অত্যন্ত বেশি। বিশেষ করে এডি আর্টিলারি বা এয়ার ডিফেন্স ইউনিটের অন্তর্ভুক্তি প্রমাণ করে যে, ড্রোন বা আকাশপথের আক্রমণ থেকেও তাকে সুরক্ষার পরিকল্পনা ছিল। এটি কেবল একটি সংবর্ধনা ছিল না, এটি ছিল একটি পূর্ণাঙ্গ সিকিউরিটি অপারেশন।

তারেক রহমানের এই ‘রাজসিক’ প্রত্যাবর্তন কেবল দেশের ভেতরেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং আন্তর্জাতিক মহলেও ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। বিশ্বের বড় বড় সংবাদমাধ্যমগুলো তার ফিরে আসার খবর অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে প্রচার করেছে। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা তার এই ফিরে আসাকে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে এক বড় পরিবর্তন হিসেবে দেখছেন। তারা তাকে ‘সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী’ হিসেবেও আখ্যায়িত করছেন। বিশেষ করে ভারতীয় ও পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমগুলো তারেক রহমানের জনভিত্তি দেখে বিস্ময় প্রকাশ করেছে।

গণমাধ্যম বিশ্লেষকদের মতে, দীর্ঘদিন ধরে তারেক রহমানকে নিয়ে যে নেতিবাচক প্রচারণা চালানো হয়েছিল, এই বিপুল জনসমর্থন সেই বয়ানকে সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছে। রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, বিশ্ব সম্প্রদায় এখন দেখছে যে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতির চাবিকাঠি কার হাতে রয়েছে। এই বিপুল জনসমর্থন যেমন তাকে শক্তিশালী করছে, তেমনই আন্তর্জাতিক মহলের নজরদারিতে থাকাও তার নিরাপত্তার জন্য একটি অতিরিক্ত রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করতে পারে। তবে একই সঙ্গে বিরুদ্ধ শক্তির জন্য তিনি এখন প্রধান লক্ষ্যবস্তু হয়ে উঠতে পারেন বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে।

স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পরদিন অর্থাৎ ২৬ ডিসেম্বর শুক্রবার তারেক রহমান রাজধানীর শেরেবাংলানগরে তার বাবা শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কবর জিয়ারত করতে যান। ছুটির দিনেও গুলশান থেকে পুরো রাস্তা ছিল মানুষের দখলে। তিনি দেশে ফেরার প্রথম দিনের মতোই লাল-সবুজ রঙের বাসে দাঁড়িয়ে নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে হাত নেড়ে শুভেচ্ছা জানান। এই সাধারণ পরিবহনে চড়ে বাবার কবর জিয়ারতে যাওয়ার সিদ্ধান্তটি ছিল অত্যন্ত কৌশলী এবং আবেগপ্রবণ। তবে এই যাত্রাটি ছিল অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।

হাজার হাজার নেতাকর্মী বাসের একদম গা ঘেঁষে স্লোগান দিচ্ছিল, যা নিরাপত্তা বাহিনীর জন্য সামলানো কঠিন হয়ে পড়েছিল। র‍্যাব ও বিজিবি সদস্যরা মানুষের এই স্রোত ঠেকাতে হিমশিম খাচ্ছিলেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, তারেক রহমান নিজেকে জনগণের একদম কাছাকাছি নিয়ে যেতে চাচ্ছেন, যা একজন গণতান্ত্রিক নেতার জন্য কাম্য। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যেখানে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার ইতিহাস অত্যন্ত তিক্ত, যেকোনো মুহূর্তে ভিড়ের সুযোগ নিয়ে দুর্বৃত্তরা অপ্রীতিকর কিছু ঘটিয়ে ফেলতে পারে।

আগামী দিনগুলোতে তারেক রহমানের কর্মসূচিগুলোতে সেনাবাহিনী বা অন্যান্য বাহিনীর বেষ্টনী ২৫ ডিসেম্বরের মতো কঠোর নাও থাকতে পারে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন। বিশেষ করে সামনে যখন জাতীয় নির্বাচন আসবে, তখন তাকে দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে নির্বাচনী জনসভায় অংশ নিতে হবে। সেই সময় নিরাপত্তা ঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে যাবে।

নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা কয়েকটি প্রধান ঝুঁকির কথা উল্লেখ করেছেন-তারেক রহমানকে এক নজর দেখার যে ব্যাকুলতা সাধারণ মানুষের মধ্যে দেখা যাচ্ছে, তাতে বড় কোনো জনসভায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারে; অনেক জায়গায় তাকে গাড়ি থেকে নেমে পায়ে হাঁটতে হবে। বুলেটপ্রুফ গাড়ি দিয়ে ঘেরা থাকলেও পায়ে হাঁটার কয়েক কদম সময় তাকে অরক্ষিত করে তুলতে পারে; বাংলাদেশের রাজনৈতিক শূন্যতায় তারেক রহমান এখন গণতন্ত্রের এক আলোকবর্তিকা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন, এই অবস্থায় যারা দেশে অস্থিতিশীলতা চায়, তাদের কাছে তিনি বড় টার্গেট। মাঠপর্যায়ে রাজনৈতিক কর্মীদের আবেগ এবং পেশাদার নিরাপত্তা বাহিনীর প্রটোকলের মধ্যে প্রায়ই সংঘাত তৈরি হয়, নির্বাচনী জনসভায় এই সমন্বয় রক্ষা করা কঠিন হবে বলে তারা মনে করছেন।

নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, তারেক রহমানের জন্য এখন প্রয়োজন একটি ‘স্ট্যাটিক’ নিরাপত্তার বদলে ‘ডাইনামিক’ নিরাপত্তা ব্যবস্থা। অর্থাৎ তিনি যেখানেই যাবেন, সেখানকার পরিবেশ অনুযায়ী দ্রুত নিরাপত্তা পরিকল্পনা বদলাতে হবে। সিএসএফকে আধুনিক প্রযুক্তিতে আরও সুসজ্জিত করতে হবে এবং রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে কোনো দলীয় প্রভাব ছাড়াই তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।

তারেক রহমানের এই প্রত্যাবর্তন কেবল বিএনপির জন্য নয়, বরং দেশের সামগ্রিক গণতন্ত্রের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। বিএনপির চেয়ারপারসনের নিরাপত্তা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) ফজলে এলাহি আকবর এই পরিস্থিতিকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখছেন।

এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তারেক রহমানের দেশে ফেরার দিন যে জনজোয়ার আমরা দেখেছি, তা সামলানো চ্যালেঞ্জিং ছিল ঠিকই, কিন্তু আমাদের নিরাপত্তা বাহিনী অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছে। অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকেও সর্বাত্মক সহযোগিতা আমরা পেয়েছি। পেশাদার বাহিনীগুলোর ওপরই নির্ভর করছি না, আমাদের নিজস্ব ‘চেয়ারপারসনস সিকিউরিটি ফোর্স’ (সিএসএফ)-কেও দক্ষতার সঙ্গে কাজে লাগানো হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, দলের নেতাকর্মীরা এত বছর পর নেতাকে কাছে পেয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছে। তবে তাদেরকে মনে রাখতে হবে, নেতাকে ভালোবাসবেন, কিন্তু নিরাপত্তার স্বার্থে শৃঙ্খলাও বজায় রাখতে হবে। আমি বিশ্বাস করি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় তারেক রহমান সম্পূর্ণ নিরাপদ থাকবেন।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. মুজাহিদুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে বলেন, দীর্ঘ ১৭ বছর পর তারেক রহমানের এই প্রত্যাবর্তন মানুষের মধ্যে তীব্র আকাঙ্ক্ষা ও আবেগের জন্ম দিয়েছে। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক শূন্যতায় তাকে প্রধান ত্রাণকর্তা হিসেবে দেখছে মানুষ। কিন্তু রাজনীতিতে যখন একজন নেতা এত বেশি জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন এবং যখন তাকে ঘিরে একটি দেশের পুরো গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ আবর্তিত হয়, তখন তিনি বিরোধী বা অশুভ শক্তির জন্য প্রাইম টার্গেট হয়ে দাঁড়ান। বর্তমান বাংলাদেশের ভঙ্গুর প্রশাসনিক কাঠামোতে তারেক রহমানের নিরাপত্তা কেবল তার দলের জন্য নয়, বরং রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতার জন্যও বড় পরীক্ষা।

১৭ বছরের নির্বাসন শেষে তারেক রহমানের এই রাজসিক প্রত্যাবর্তন বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে একটি মাইলফলক। ২৫ ও ২৬ ডিসেম্বরের ঘটনাবলি প্রমাণ করেছে যে, দীর্ঘ সময় দেশের বাইরে থাকলেও মানুষের হৃদয়ে তার অবস্থান বিন্দুমাত্র ম্লান হয়নি। তবে এই আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা এবং মানুষের বাধভাঙা ভালোবাসা যেন তার নিরাপত্তার পথে অন্তরায় হয়ে না দাঁড়ায়, সেদিকে গভীর নজর দিতে হবে বলে মত দিচ্ছেন রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টরা।