• ডিসেম্বর ৫, ২০২০
  • Uncategorized
  • 355
বেলার গণশুনানি: ‘দুর্গন্ধের কারণে এলাকায় কেউ আত্মীয়তা করে না’

হবিগঞ্জ প্রতিনিধি: ‘শিল্পদূষণে আমাদের এলাকা এতটাই দূষিত হয়েছে এখানে নিঃশ্বাস ফেলা যায় না। মার লিমিটেড কোম্পানির সৃষ্ট দুর্গন্ধের কারণে এই এলাকায় কেউ আত্মীয়তা করতে চান না। বলতে লজ্জা লাগে, এই এলাকার ছেলে মেয়েরা উচ্চ শিক্ষিত, সুশ্রী হলেও এখানে কেউ ছেলে মেয়ে বিয়ে দেন না।’

কথাগুলো হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলার রাজিউরা ইউনিয়নের এক্তিয়ারপুর গ্রামের বাসিন্দা শিক্ষক মোছা. মারুফা আক্তারের। শিল্পদূষণ নিয়ে শনিবার (৫ ডিসেম্বর) হবিগঞ্জে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) আয়োজনে গণশুনানিতে এসব কথা বলেন তিনি।

মারুফার মতো একই সমস্যার কথা উল্লেখ করেন আব্দুল কাইয়ুম, মুফতি আলমগির হোসেন, মোছা. শামছুন্নাহার বেগমসহ শিল্পদূষণে ভুক্তভোগী এলাকার বেশিরভাগ বাসিন্দা।

হবিগঞ্জের রাজনগরস্থ জেলা শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে সকাল ১০টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত গণশুনানি অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন হবিগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ কামরুল হাসান।

হবিগঞ্জ জেলার সদর, শায়েস্তাগঞ্জ ও মাধবপুর উপজেলাতে বিপুল সংখ্যক শিল্প প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ঢাকা সিলেট হাইওয়ে সংলগ্ন মাধবপুর উপজেলাতেই এসব শিল্প প্রতিষ্ঠানের অবস্থান বেশি। কোনো ধরনের নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে এসব এলাকার কৃষিজমি, আবাসিক এলাকায়ও (গ্রাম) গড়ে উঠছে শিল্পকারখানা। দিন দিন এর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এসব শিল্পকারখানা সমাজের একটা শ্রেণী লাভবান হলেও শিল্পদূষণে জনস্বাস্থ্য ও আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে বিরাট নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এর প্রেক্ষিতে ‘হবিগঞ্জে শিল্পদূষণ ও জনদূর্ভোগ নিরসনে করনীয়’ শীর্ষক গণশুনানির আয়োজন করে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা)।

গণশুনানিতে সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন হবিগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আনোয়ার হোসেন, পরিবেশ অধিদপ্তর সিলেটের পরিচালক মোহাম্মদ এমরান হোসেন, হবিগঞ্জের সিভিল সার্জন ড. একেএম মোস্তাফিজুর রহমান, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) হবিগঞ্জের সভাপতি অধ্যাপক ইকরামুল ওয়াদুদ।

গণশুনানি সভাপতিত্ব ও পরিচালনা করেন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। মূলপ্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বেলার নেটওয়ার্ক মেম্বার খাইরুল হোসেন মনু ও জালাল উদ্দিন রুমি।

গণশুনানীতে স্থানীয় ক্ষতিগ্রস্ত ও ভুক্তভোগী জনগণ, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের মালিকপক্ষ, সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা, সাংবাদিক, শিক্ষক, আইনজীবী, ব্যবসায়ী, সমাজকর্মী, পরিবেশকর্মী ও জনপ্রতিনিধিসহ সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) পক্ষ থেকে শিল্পদূষণের প্রভাব, গৃহীত উদ্যোগ, বর্তমান অবস্থা, সুপারিশমালা নিয়ে আলোচনা করা হয়।

হবিগঞ্জে গড়ে উঠা এসব শিল্পকারখানার ফলে পরিবেশ দূষণ (মাটি, পানি ও বায়ু দূষণ) শব্দ দূষণ, জনস্বাস্থ্য, আর্থ-সামাজিক, কৃষি, শিক্ষা, মৎস্য সম্পদ, প্রাণী ও পশু সম্পদের ক্ষতি, প্রাকৃতিক সম্পদের অপরিকল্পিত এবং অবৈধ আহরণ বৃদ্ধি, বন, বাগান ও চা শিল্পের উপর প্রভাব পরেছে। এছাড়াও দেশের আইন-আদালতকে উপেক্ষা করার প্রবণতা বৃদ্ধির আশংকা রয়েছে বলে বেলার পক্ষ থেকে জানানো হয়।

শিল্পদূষণ ঠেকাতে বেলার পক্ষ থেকে মার লি. কর্তৃক দূষণ রোধে এটি ঘোষিত শিল্প এলাকায় স্থানান্তর ও দূষণের কারণে ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ ও তা আদায়ের দাবী জানিয়ে গত ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২০ একটি লিগ্যাল নোটিশ প্রদান করেছে। এছাড়া সরকারি উদ্যোগে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে বিভিন্ন সময়ে জরিমানা আরোপ ও পরিবেশ সম্মতভাবে শিল্পপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতে নোটিশ প্রদান করা হয়েছে বলে বেলা পক্ষ থেকে জানানো হয়।

গণশুনানীতে বেলার সুপারিশমালায় ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণের দাবী জানানো, জরুরিভিত্তিতে গ্রামাঞ্চল ও জলাভূমিগুলোকে দূষণমুক্ত করা, বিভিন্ন এলাকায় যেসব শিল্প প্রতিষ্ঠান তাদের কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে সামাজিক ও পরিবেশগত নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে তাদের প্রত্যেককে জবাবদিহিতার আওতায় নিয়ে আসার কথা উল্লেখ করা হয়।

মুক্ত আলোচনায় শিল্পদূষণে ভুক্তভোগী এলাকার মানুষজন ও বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন।

ভুক্তভোগীরা বলেন, ‘শিল্পাঞ্চল এলাকায় আগে যেখানে জমিতে প্রতি বিঘা ৮ মন করে ধানের ফলন হতো, সেখানে এবছর প্রতি বিঘা মাত্র তিন মন ধান হয়েছে। এলাকার অনেক জমিতে ফসল হচ্ছে না। শাক-সবজি উৎপাদন হচ্ছে না। এলাকার নদী খালে এখন মাছ পাওয়া যায় না। গাছে পাখি বসে না। দুর্গন্ধের কারণে এসব এলাকায় কেউ ছেলে মেয়ে বিয়ে দিতে চান না। এলাকার মানুষজন ফুসফুস ইনফেকশন, কিডনি, শ্বাসকষ্ট, চর্মসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন।এলাকার নদীগুলো মরে যাচ্ছে। এসব শিল্পপ্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে এলাকারা যারা প্রতিবাদ করেন তাদের বিভিন্ন ভাবে আক্রমণ করা হয়। হত্যার হুমকি দেওয়া হয়। মাদক দিয়ে ফাঁসানোর চেষ্টা করেন কোম্পানির লোকজন।’

প্রধান অতিথির বক্তব্যে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ কামরুল হাসান বলেন, ‘শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিকদের বিবেককে কাজে লাগাতে হবে। কারণ সর্বোপরি তারাও মানুষ। এই এলাকার মানুষের মত তাদেরও পরিবার পরিজন রয়েছে। আমি বলবো আপনার নিজেরা সংশোধন হন। আপনাদের শিল্প প্রতিষ্ঠানের ইটিপি থাকবে না, নিয়ম মানবেন না তা হবে না। আইনে যদি আপনার প্রতিষ্ঠান বন্ধ করতে হয় তবে প্রতিষ্ঠান বন্ধ করতে হবে। যারা পরিবেশ কর্মীদের হেয় প্রতিপন্ন করবেন তাদেরও ছাড় দেওয়া হবে না। এসব অনিয়মের ক্ষেত্রে আমরা কোনো ছাড় বা সমজোতায় যাব না। শিল্প প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে উন্নয়ন করতে হলে পরিবেশ ঠিক রেখেই উন্নয়ন করতে হবে। আমার কোনো সহকর্মী প্রশাসনের লোক এসব অনিয়মে জড়িত থাকলে আমাকে জানাবেন, আমি ব্যবস্থা নেব। এছাড়ারও অত্র এলাকার এসব সমস্যা নিয়ে নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি করে তদন্ত করা হবে। সর্বোপরি সবাইকে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে।’

পরিবেশ অধিদপ্তর সিলেটের পরিচালক মোহাম্মদ এমরান হোসেন বলেন, ‘এখানে যেভাবে যত্রতত্র শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে এতে ভবিষ্যতে অনেক বিপর্যয় ডেকে আনবে। এসব শিল্প প্রতিষ্ঠানে অনেক শব্দদূষণ হচ্ছে। কোনো শিল্প প্রতিষ্ঠানের পরিবেশগত ছাড়পত্র না থাকলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এখানে মার লিমিটেডের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ আছে। আমার অনেকবার এই কোম্পানিকে জরিমানা করেছি। প্রাণ আরএফএলএর সব প্রতিষ্ঠানের ইপিটি নাই। আমি স্পষ্ট বলতে চাই যে শিল্প প্রতিষ্ঠান মানুষের ক্ষতি করবে তাদেও ছাড় দেওয়া হবে না।’

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে উন্নয়ন হবে, তবে পরিবেশ প্রতিবেশ বজায় রেখে। নৈতিকতার দায়বদ্ধতা থেকে সবাইকে কাজ করতে হবে। কারণ পরিবেশ রক্ষায় সকলের দায়িত্ব আছে। ভূমিদস্যুদের সাথে জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করা হবে। যদি এসব এলাকায় প্রশাসন পুলিশ কোনো পক্ষপাতমূলক আচরণ করেন তবে আমাকে জানান, আমি ব্যবস্থা নিব। উন্নয়ন করলে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রেখে করতে হবে। হুমকি ধমকি দিয়ে কাজ হবে না।’

সভাপতির বক্তব্যে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘আমরা কৃষি জমিতে শিল্পপ্রতিষ্ঠান চাই না। এসব শিল্পদূষণে যেসব ক্ষতি হয়েছে এর নিরপেক্ষ তদন্ত করতে হবে, এবং এলাবাসিকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। মানুষ নিঃশ্বাস পারছে না আর আপনারা বলবেন উন্নয়ন হচ্ছে তা হবে না।’

এছাড়াও বক্তব্য দেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) হবিগঞ্জের সহসভাপতি তাহমিনা বেগম গিনি, মনসুর উদ্দিন আহমেদ ইকবাল, বাপা হবিগঞ্জের সাধারণ সম্পাদক তোফাজ্জল সোহেল, প্রথম আলোর জেলা প্রতিনিধি হাফিজুর রহমান নিয়ন, দৈনিক দেশ রূপান্তরের জেলা প্রতিনিধি শোয়েব চৌধুরী।

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •