• ডিসেম্বর ১৬, ২০২২
  • লিড নিউস
  • 204
গোয়াইনঘাটে পূর্ণানগর বধ্যভূমি স্থায়ীভাবে সংরক্ষণ করার উদ্যোগ

নিউজ ডেস্কঃ সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার পশ্চিম আলীরগাঁও ইউনিয়নে গোয়াইন নদীর পারে পূর্ণানগর গ্রাম। মুক্তিযুদ্ধের সময় এই গ্রামে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী একটি ক্যাম্প স্থাপন করেছিল। এরপর স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় বিভিন্ন সময়ে সে ক্যাম্পে নিরীহ মানুষদের ধরে এনে আটকে রেখে চালানো হতো নির্যাতন।

অনেককে গুলি করে হত্যা করে ভাসিয়ে দেওয়া হয় নদীর পানিতে। স্থানীয়ভাবে স্থানটি বধ্যভূমি হিসেবে পরিচিত হলেও কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তির দখলে থাকার কারণে স্থানটি এত দিন সংরক্ষণ করা যায়নি। এ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা ও গ্রামবাসীর মনে ক্ষোভ ছিল।

স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ও এলাকাবাসীর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে স্থানীয় প্রশাসন বধ্যভূমিটি দখলে এনে স্থায়ীভাবে সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে। সেখানে একটি স্মৃতিসৌধ স্থাপন করা হবে। গত বুধবার বেলা দেড়টার দিকে সেখানে প্রথমবারের মতো পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হয়। আজ ১৬ ডিসেম্বর বধ্যভূমিতে নির্মিতব্য স্মৃতিসৌধের ভিত্তিপ্রস্তর আনুষ্ঠানিকভাবে স্থাপন করা হবে। এ অনুষ্ঠানে স্থানীয় সংসদ সদস্য, প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইমরান আহমদ প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে।

বুধবার পুষ্পস্তবক অর্পণকালে গোয়াইনঘাটের ইউএনও তাহমিলুর রহমান, এএসপি প্রভাস কুমার সিংহ, উপজেলা চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ফারুক আহমদ, সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আবদুল হক, উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মুহাম্মদ গোলাম আম্বিয়া ও মোছা. আফিয়া বেগম, গোয়াইনঘাট থানার ওসি কে এম নজরুল প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

স্থানীয় প্রশাসন জানিয়েছে, গত জুন মাসে উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ও মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কমান্ড বধ্যভূমিটি সংরক্ষণ করে স্মৃতিসৌধ নির্মাণের দাবিতে মানববন্ধন করে। এরপরই স্থানীয় প্রশাসন বধ্যভূমি উদ্ধারে তৎপর হয়। প্রভাবশালী কিছু ব্যক্তি পূর্ণানগর গ্রামে কোনো বধ্যভূমি ছিল না দাবি করায় এত দিন গ্রামের বধ্যভূমি চিহ্নিত করা যায়নি। এ সময় উপজেলা সহকারী কমিশনার তানভীর হাসানকে প্রধান করে স্থানীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে বধ্যভূমি চিহ্নিত করার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়। সে কমিটি ব্যাপক যাচাই–বাছাই করে বধ্যভূমির স্থানটি চিহ্নিত করে।

তবে প্রায় আধা কিলোমিটার এলাকাজুড়ে থাকা বধ্যভূমিটি গোয়াইন নদীগর্ভে থাকায় সেখানে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা সম্ভব হয়নি। তাই নদীর তীরে প্রায় ৬ শতক ব্যক্তিগত জমির ওপর স্মৃতিসৌধ স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। স্মৃতিসৌধ নির্মাণের জন্য গ্রামের তিন ব্যক্তি জায়গাটি দান করেছেন। এ তিনজন হচ্ছেন আবদুল মুতলিব, আতিকুর রহমান ও হাফিজ উদ্দিন।

এলাকাবাসী জানান, একটি মহলের বাধার কারণে পূর্ণানগর গ্রামের বধ্যভূমিটি স্থায়ীভাবে সংরক্ষণ করা যায়নি। এখন বধ্যভূমির স্থানটি চিহ্নিত হওয়ায় সবাই খুশি। এখানে অনেক মানুষ হত্যা করে নদীর পানিতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ২৩ জন শহীদের নাম-ঠিকানা ও পূর্ণাঙ্গ তথ্য স্থানীয় প্রশাসন সংগ্রহ করেছে। এলাকাবাসীর সহযোগিতায় শহীদ হওয়া অন্যদের তথ্য সংগ্রহে কাজ চলছে।

পূর্ণানগর বধ্যভূমিতে শহীদ হওয়া যে ২৩ জনের নাম-ঠিকানা সংগ্রহ করেছে প্রশাসন, তাঁরা হচ্ছেন উপজেলার বার্কিপুর গ্রামের আবদুস সোবহান; লামা সাতাইন গ্রামের তৈয়ব আলী ও আবদুল লতিফ; পূর্ব আলীরগাঁও গ্রামের আবদুস সালাম, আবদুল লতিফ, আবদুল জলিল, আবদুল হক, ইশরাক আলী, আবদুল সালাম ও আবদুল হক; বাউরভাগ গ্রামের মনির উদ্দিন, মঈন উদ্দিন ও আবদুর রহমান; নয়াগ্রামের মো. কেরামত আলী, দোয়াত আলী, আকতার উদ্দিন, নবাব আলী, নওশের আলী, দুদু মিয়া, আ. রহমান, নেদু খাঁ, সাকের ও অহালী।

গোয়াইনঘাটের ইউএনও তাহমিলুর রহমান বলেন, এ বধ্যভূমিতে শহীদদের নামসহ মুক্তিযুদ্ধের যাবতীয় তথ্য রাখা হবে। এতে করে এ অঞ্চলের বাসিন্দা ও পরবর্তী প্রজন্ম মহান মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস সহজে জানতে পারবে।

একাত্তরে বাবাকে হারানোর ঘটনার বর্ণনা দেন বার্কিপুর গ্রামের আবদুল মালিক (৫৭)। তিনি জানান, তখন তাঁর বয়স ছয় বছর। সন্ধ্যার সময় তাঁর বাবা আবদুস সোবহান হাওর থেকে গরু নিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন। তিনিও সঙ্গে ছিলেন।

পথে কয়েকজন পাঞ্জাবির সঙ্গে তাঁদের দেখা হয়। ওই পাঞ্জাবিরা তাঁর বাবাকে পূর্ণানগর গ্রামের পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্পে নিয়ে যায়। পরদিন অপেক্ষা করলেও তাঁর বাবাকে মুক্তি দেয়নি।

পাকিস্তানি সেনারা পরদিন ক্যাম্পে আসতে বলে। সে অনুযায়ী পরদিন ক্যাম্পে গিয়ে তাঁর বাবাসহ আগের দিন কোমরে রশি বেঁধে ক্যাম্পে বসিয়ে রাখা অন্য ১২–১৪ জনকে তাঁরা আর খুঁজে পাননি। পরে জেনেছেন, তাঁদের হত্যা করে নদীর পানিতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে।